রবীন্দ্র গুহ-র স্ল্যাং-প্রযুক্তি

অজিত রায়

আমাদের বাদ-বাঙলার লেখকদের পারস্পরিক মেলামেশার কেতাকায়দা খানিক আলাদ। তিনজনের কথা অস্তুত এই সুবাদে বলাই যায়। রবীন্দ্র গুহ, কমল চক্রবর্তী আর সুবিমল বসাক। এঁদের সঙ্গে কালেভদ্রে ভেঁট হয়ে গেলে আমাদের মধ্যে পুরনো খোরবানি কোড ওয়ার্ডে হালচাল আমদোরফৎ হয়। কা হো বাবুয়া, খপচ ভালো তো? ‘খপচ’ শব্দটা এবিসি-দের (আরা-বালিয়া-ছাপরা) ভোজপুরী ফ্লাইং গ্লোসারি থেকে কমলদা আর সুবিমলদার গ্যাঁড়ানো। আমিও অমনি, মেজাজ ঠাউরে ওঁদের আছোলা ঝাড়খণ্ডী স্ল্যাং শুনিয়ে দিই সেম বেরাদরিতে যা হয় আর কী! রবীন্দ্রদার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সামান্য হেলে হলেও, কমবেশি একই। তিনি মাঝেমধ্যে এমনসব শব্দ বা স্ল্যাং শোনান, শুনে ব্যোম্‌ হয়ে যেতে হয়।

রবীন্দ্র গুহর লেখালেখির গঠনপ্রকৃতি তথা ভাষাপ্রযুক্তি নিয়ে আলোকনের যথেষ্ট অবকাশ। অথচ বিষয়টা নিয়ে আলোচকদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি এদান্তি। তথাকথিত প্রথাবিরুদ্ধ ব্রাত্য সাহিত্যভাষার কিঞ্চিৎ ইশারা তিনি লাভ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনসদৃশ প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে। বাংলার বনেদি শব্দঘরানা পরিত্যাগ করে ব্যতিক্রমী ও নতুন শব্দের প্রতি আমার আসক্তি গোড়া থেকেই লক্ষ করে থাকবেন পাঠক। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে রবীন্দ্রদার সুরে সুর মিলে যায়। নিজের কাছাকাছি অনুভব করি। মনে হয়, অন্তত শব্দ-বানাবার প্রবৃত্তির দিক থেকে ইনি আমার অন্যতম অগ্রজ।

 রবীন্দ্রোত্তর যুগে আঙুলে-গোনা যে কজন বাঙালি লেখা অরাবীন্দ্রিক গদ্যের রেওয়াজ করে পাঠক ও সমালোচক মহলের মনোযোগ দাবি করেছেন, রবীন্দ্র গুহ সেই বিরলতমদের অন্যতম। রবীন্দ্র একটি নিজস্ব গদ্যপ্রযুক্তি প্রস্তুত করেন, যা হলো ‘পুরুষালি’। সেটি প্রথম প্রকাশ পায় শিকঞ্জের পাখি খামোশ উপন্যাসে, ২০০০ সনে, শহর-এর পাতায়। কাজটি অভিনব ও একপ্রকার অসাধ্যসাধন নিঃসন্দেহে। কালেকালে বাংলা গদ্য কত কলাবাজিই না দেখল, তাকে পুনঃ আমোদিত করা কঠিন ছিল। রবীন্দ্র গুহর ম্যাসকুলিন ভাষা ও ডিসকোর্স বাংলা গদ্যে সত্যিই এক অভিনব সংযোজন। তাঁর সাব-অলটার্ন ভাষা ছাঁদটি উঠে এসেছে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-বৰ্দ্ধমান আর ধানবাদ-আসানসোল-রানীগঞ্জের পাঞ্জাবি মোড় থেকে কলকাতার রক-গ্যাঁজানো ক্লিশে শব্দসম্ভার নয়, না মুড়ি-আলুচপের বাসি বাতকর্ম। বাংলা বিহার রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ ছত্তিশগড় হরিয়ানা একাকার করে ভুল করে নয়, ডেলিবারেট পাঞ্জা এক অনাস্বাদিত, বিশাল বলনকেতার নিষ্ঠাবান খেলোয়াড় রবীন্দ্র গুহ। অর্থাৎ, তাঁর লেখালেখির মূল উপজীব্য শিল্পাঞ্চল। এটাই তাঁর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ও ব্যতিক্রম। বিগত পাঁচ দশকের লেখালেখিতে তাঁর গদ্যের বিষয়ে ও চরিত্রে প্রধানত শিল্পাঞ্চলের রবীন্দ্র গুহর লেখালেখির মূল উপজীব্য শিল্পাঞ্চল। এটাই তাঁর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ও ব্যতিক্রম। এই মনবিশ্ব বা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র গুহর একক অভিজ্ঞতা ও অবিকৃত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা তাঁর সাহিত্যকে ঋদ্ধ তথ্য অন্যান্যদের থেকে আলহিদা করেছে।

 বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এমন লেখকের নিতান্ত অভাব, যাঁর ভাষা একেবারে আঁটি থেকে মৌলিক। ভাষাপ্রযুক্তির দিক থেকে তিনি একেবারেই অন্য কারো মতো নন একটুও। রবীন্দ্র গুহর ভাষাপ্রযুক্তি এতখানিই বেপোট যে অকস্মাৎ যদি কোনো অদীক্ষিত আনাকোরা পাঠক তাঁর লেখা পড়ে ফেলেন, চট্ করে হজম করতে পারবেন না। ‘ভাষার এ কী ছিরি রে বাবা! পাছার ওপর ভর দিয়ে ভেকের ন্যায় তড়াক তড়াক লাফিয়ে চলে মোহন—’। কিন্তু হচ্ছে খাঁটি রবীন্দ্র গুহ। সেন্ট হিসেবে গায়ে মাখার পক্ষে ইলিশ মাছের আইডেনটিটি এবং পপুলারিটির হেতু। ইলিশমাছের গায়ে ভেটকির গন্ধ হলে ভেটকি আর ইলিশ দুয়েরই মান যায়। রবীন্দ্রর ভাষা ব্যবহার সুচিন্তিত ও ডেলিবারেট।

 বলবার কথা এই যে, তাঁর গদ্যের যে-কোনও পৃষ্ঠা পড়লেই তাঁকে শনাক্ত করা যায়। আশপাশের তামাম শব্দ আহরণে সদাই ব্যস্ত। শব্দ শরব্যতায় কোনরকম ছুঁৎমার্গ নেই। দেশি-বিদেশি রুখাসুখা টাঁড়বাদাড় আর শিল্পাঞ্চলের অনতিজ্ঞাত সব শব্দ। এ ব্যাপারে তাঁর সাফ কথা: ‘লেখক একাহারী কুত্তা-বিশেষ জীব নয় যে সারাজীবন শুধু সেউ-খেউ করে যাবে। তিনি নানারকম শব্দ জানেন, বানাতে সক্ষম, ফলত শোনাতে উন্মুখ।’ তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে লেখা রবীন্দ্রর গদ্যও বেশ টগবগে ছিল, নতুন ছিল, এখনও সমকালীন মনে হয় এটাই তাঁর নিজের কালবৃত্ত থেকে এগিয়ে থাকার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাঁর জীবন-পরিধির আওতায় যে-যে ভাষার সংসর্গ ঘটেছে হিন্দী, মারাঠি, রাজস্থানী, ছক্তিশগঢ়ী, হরিয়ানভি, উর্দু এবং লোকাল আঞ্চলিক ও দেহাতি তথাকথিত দুঃশীল ভাষা, সংলাপ ও প্রয়োগ যথেষ্ট মুনশিয়ানাসহ উঠে এসেছে তাঁর সাহিত্যে। ক্রমেক্রমে বুড়ি ছুঁয়ে নিম্ন, নিম্ব, নিম, ইতি ভাষার জিগিরও আসবে। একদা যা ঝুগ্গিঝুপড়ি আর ঘাটিবস্তিতে চালু ছিল, পরে গ্লোবাল কালচারে। তারই সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধেছে তথাকথিত স্ল্যাং বা অপভাষা, অপশব্দ, ইতর ও খণ্ডিত গন্ধবাহী শব্দ। খোলসা করে বললে, স্থূল, সূক্ষ্ম, পৃথুল, অভদ্র, শালীন অশালীন, আটপৌরে, প্রাকৃত-অপ্রাকৃত সংলাপ ও কথোপকথন। কেবলমাত্র গন্ধবাহী নয়, কচ্চিৎ তা যাদুকরী, কখনো-বা জলঙ্গলের আবার কখনো ক্ষিপ্ত ক্ষুৎকাতর অদ্ভুত টালমাটাল অপবিত্র গদ্যভাষার এমন কিছু ব্যবহার যা যুগপৎ অম্লমধুর, কটু তথা নুনতুল্য তিক্তবিরক্তিকর। এভাবেই রবীন্দ্র গুহর সাহিত্যে অভিজ্ঞতাঋদ্ধ ধোঁয়াধুলোমাখা খরতপ্ত ভাষার বিস্তর মোহগন্ধ ও লাঞ্ছনার ললছোঁয়া আছে, যা মহানগরের বাঘা-বাঘা আমলা-গপ্পোকারদের লেখায় দুর্লভ।

 রবীন্দ্র গুহর ভাষা ও শব্দ গঠনপ্রযুক্তি কী-বিধায় ভিন্ন, সেটা সংক্ষেপে ড. শিপ্রা বসু বলেছেন, 

‘‘রবীন্দ্র গুহর শজারুর কাঁটার মতো devogatory ভাষা মারাত্মক। আভাগার্দ লেখক হিসেবে তিনি সীমান্ত ভাঙতে চান, কিন্তু আমাদের নরকদর্শন হয়ে যায়।… বিশেষ করে ইদানীং শিবশরণে আত্মধ্বংসের আখ্যান বুকে চেপে বসে। পাঠকৃতি নিছক পাঠকৃতি নয়, সত্তর দহন। রুচি-শাসকেরা যাই বলুন, সত্যসন্ধানের মতই লাগসই শব্দ-সন্ধান করতে হয়।”

 আজকের বাণিজ্য-বহির্ভূত লেখালেখির জগতে কিছু কিছু লেখকের মধ্যে প্রথাবিরুদ্ধ সাহিত্য রচনার তথা ভাষাকে আক্রমণ করার প্রবণতা দেখে স্বস্তি ও উমেদ জাগে যে অচিরেই হয়ত বাংলা ভাষার সর্বাত্মক ও বৃহত্তর পরিমার্জনার জন্য চাপ সৃষ্টি হবে। আজকের বাণিজ্য-বহির্ভূত বৃহত্তর বঙ্গীয় লেখক সমাজে সৃষ্টিশীল রচনাগুলি বহুলাংশে স্ল্যাং বা সাব-অলটার্ন ভাষা-নির্ভর, বলা চলে। তা গল্প উপন্যাস কবিতা সর্বমণ্ডলে প্রযোজ্য। বাংলা লিট্‌ল ম্যাগাজিনের ধারাবাহিক অস্তিত্ব জায়মান আন্দোলনের জেরেই এই সুলক্ষণ প্রসূত হয়েছে। নতুবা এত আথিবিথি ও স্বচ্ছভাবে এই পরিবর্তনের প্রেক্ষা ধরা পড়ত না। কারণ, ভাষার গতি গ্লেসিয়ারের মত, খুব ধীর। হুড়মুড় করে পড়ে যাবার, নতুন বাঁক নেবার প্রক্রিয়াটি একজীবনে চাক্ষুষ করা সহজ নয়। সেটি বর্তমান প্রজন্ম দেখে যেতে পারবে, ভরসা।

 স্ল্যাং একটি স্পর্শকাতর শব্দভাণ্ডার। যথাযথ ব্যবহারে হীরের দ্যুতি, নতুবা নিছক পাথরখণ্ড। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি স্ল্যাং ও শব্দের মধ্যে ফারাক মানি না। বরং মনে করি, বাণিজ্য-বহির্ভূত বৃহত্তর বঙ্গীয় সমাজে এখনকার যাবতীয় সৃষ্টিশীল রচনাই স্ল্যাং ভাষায় লিখিত। এদিক থেকে দেখলে বাংলা সাহিত্যে স্ল্যাং নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উলেমারা যা ‘অশ্লীল’ ‘অশালীন’ বা ‘অপশব্দ’ বলে দাগায়িত করেন তা স্রেফ তাঁদের বিদ্যাগত ও পেশাগত বিড়ম্বনা। খিস্তি-খেউড়ও কি সে-অর্থে স্ল্যাং? রবীন্দ্র গুহর ব্যবহার করা ‘শালো গানডু, মালিকের নেমড়া’ অথবা, ‘শ্লা চুত্‌মারানি’ অথবা, ‘চিকনি-চুবড়ি ভুসড়ি’— অথবা ‘আর ঘচু মেরা ল্যান্ড পকড় লে’ এসকল শব্দের অর্থ যারা অবগত নয় তাদের চোখে এগুলো স্ল্যাং। এসব সংলাপের যথাযথ ব্যাখ্যার আগে জেনে নেয়া দরকার গঁবারু বা দেহাতি শব্দের বিধিবদ্ধ ইস্তেমাল কেন ও কীভাবে করা হয়। ইত্যকার শব্দের উগ্র-খর শব্দ-উল্লম্ফনের ঝাঁঝটাই বড়ো। গঁবারুর (vulgar, ইতর), গঁবারী (vulgarity, ইতরতর), গঁবারু (vulgarism, ইতরতর খিস্তি)। এখানে ‘গাঁড়’ থেকে ‘গান্ডু’, অথবা পাছায় খাপমারা। ইহ শব্দে হিন্দী পাচন আছে। যেমন গন্‌জু, কেকড়ে, লোমড়ি, কুড়িয়াঁ, ঘোন্‌চু গদ্হা। ‘মালিকের নেমড়া’ অর্থাৎ মালিকের পালতু কুত্তা। ‘চিকনি-চুপড়ি’ মানে সুন্দর পানিদার চেহারার চিক্কু অথবা মেয়ে।

 কোন কোন বিদগ্ধ সমালোচকও রবীন্দ্র গুহর তথাকথিত ইতর, হীন ও খণ্ডিত শব্দ বলতে তাঁর নিম উপন্যাসের কিছু গঁবারু শব্দের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক্ষেত্রে অবশ্য তাঁরা শ্লা বেজন্মা, হারামখোর, লছিলা নক্কু মেয়েমানুষ, পাখণ্ডী ইত্যাদি হিশেবের খাতায় নথিভুক্ত করেননি। হয়ত-বা এগুলি নিতান্তই স্থূল আটপৌরে অপশব্দ। মিশ্র ভাষাকে বাদ দিয়ে ইতর ও খণ্ডিত গঁবারু বুলি, যথা গান্ডু, মালিকের নেমড়া, ভোঁসড়ি, চুত্‌মারানি, খুবনি, ভ্যায়ন্‌চোদ এগুলোকেও স্ল্যাং বলার কোনো যুক্তি নেই। তাই বলে, হ্যাঁ, ফুৎকার দিয়ে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। শীৎকারের ভাষা, অনুরাগের ভাষা যে দুঃশীল হলেও স্ল্যাং নয়, তা পাহাড়পুর মন্দিরের শবরশবরীর মদনমত্ততার ভিত্তিচিত্রে সপ্রমাণিত। যদিও আধুনিক শিক্ষিতনেত্র এগুলিকেই ক্ষেত্রবিশেষে স্ল্যাং ঠাহর করে।

 দুঃশীল নয় অথচ তথা অর্থে স্ল্যাং বলে দাগায়িত, এমন শব্দ রবীন্দ্রসাহিত্যে ছড়াছড়ি। তিনি লক্ষ করেছেন বাঙলার সীমান্তে তথা ওপারে বিস্তর দুঃশীল শব্দ আছে যা পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্যে অচ্ছ্যুৎ বা অব্যবহৃত থেকে গেছে। এবম্প্রকার শব্দ গৌড়বাঙলায় যুক্ত হলে আমাদের সাহিত্য শক্তি ও এনার্জি লাভ করবে তথা ছালছাঁদ বদলাবে। যেমন, গোঁধলা, গাভুরানি, গাঁদাল, ওছলা, কচি যন্তর, উরুৎ ভিতর, গোমুইখ্যা, ছ্যাবলাচোদা, পিরিতির কিরা, চুতর, বাড়া, চুদিরভাই, ভোঁদা শুয়ার, ভ্যাটকা যৈবন, চোৎরামি, হালায় বলদা, ডিঙড়া, পুটকি, ঘেঁটিচোদা, শরীলের উপর শরীল, ছেমড়ির পিতলা হাসি, লোচ্চা, গতরে কারেন্ট ঠেইস্যা, চুমাই দি, ফ্যাৎফ্যাৎ শরীর, ঊরৎনাচ, ঘিষাঘিষি, চ্যাটের বাল, সাউমারানি, গুষ্টির চুদি, তুই শ্লা মাইয়া মাইনুষের অধম, চোদনা, গতরের সোয়াদ, চোহে চোহে চক্ষু, খানকি, স্তনপীড়ন, ঢলানি, লেদনচোষন, মাইয়্যার টলটইলা বুক, মহাচুদ, ভোন্দার লেহন, তোর গুদে ধোন হোন্দাইয়া দিমু। রবীন্দ্র গুহর উপন্যাস-গল্পে এসব শব্দের ব্যবহার অতিশয় অকৃত্রিম ও সহজ। সব শব্দই ঘেন্নার নয়, ফ্যাসা নয়, অথচ বুক কাঁপায় শনশন, ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ড. শিপ্রা বসু ‘devogatory ভাষা মারাত্মক’ বলতে যা-ই বোঝাতে চান, এক্ষেত্রে মন্তব্যটি একেবারেই যথার্থ নয়। এ-কথা ঠিক যে রবীন্দ্র গুহর লেখায় কিছু গাজোয়ারি শব্দ, ফষ্টিনষ্টির শব্দ, ফক্কুড়ির শব্দ আছে— যা তিনি নিজেই স্বীকার করে থাকেন। কিন্তু তাতে ঘৃণা বা ভড়ং নেই। নিছক হীনত্ববোধে সেসকল শব্দ বাতিল করা যায় না। তাঁর নিজস্ব সাফাই হলো,— “আমাদের জীবনের চারপাশের সেইরকম ভাষা-শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আমার ‘হাসান তারিকের ইলিশে’। এই কাব্যগ্রন্থে এহেন শব্দ প্রচুর আছে বলেই এটি ‘ডায়াসপোরিক কবিতা সংকলন’ নামে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের মতো কবিতায়ও যে দ্রুত ট্র্যাক বদল, টেক্সট বদলাচ্ছে, বুলিছাঁদ বদলাচ্ছে, এটা তার অন্যতম প্রমাণ। লুকোছাপা না রেখে ব্রাত্যশব্দ পালিশ না করে ব্যবহার করা হচ্ছে এখনকার বাংলা গদ্য ও পদ্য সাহিত্যে। সম্ভবত এর শুরুয়াৎ সুবিমল বসাকের ষাট দশকে লেখা ‘ছাতামাথা’ থেকেই। হাইব্রিডিটি, নমাতিকতা, সাব-অলর্টান রিয়ালিটি ডায়াসপোরিক গদ্যও ও কবিতার অন্যতম ফ্লেবার। এটা রবীন্দ্র গুহ হাড়েমজ্জায় স্বীকার করেন। রুচির প্রশ্নকে তিনি পাত্তা দেন না। তাঁর মতে, আসল হচ্ছে গ্রহণ ক্ষমতার সামর্থ্য। এটা বুঝেছিলেন সাদাত হাসান মান্টো, ইসমত্‌ চুগতই, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু।

 যেখানে জীবনের গতি চোরা-স্রোতে আটকা নয়, মন্থর নয়, সেখানে ভাষাশব্দ কোনও বাধা বা অযোগ্যতার দখল মানে না। ‘প্রাসঙ্গিক সবকিছুর অবাধ প্রস্তুতি’— এটাই মান্য করেন রবীন্দ্র,— ‘স্বপ্নের মধ্যে পরীর মত পুষ্পসকল যেমন, তেমনি মহিমা। যে যত নিখুঁত ভাবে পরিচর্যা করতে পারে তার মুখশ্রী তত উজ্জ্বল। চারপাশে কতরকমের ভাষা-শব্দ, রহস্যময় হিম করে দেয়া, শিরা-ধমনী কাঁপানো! ভাঙচুর করতে গেলে গভীর পরিচর্যার ফলে কখনো কখনো শব্দের রূপদোষ ঘটে। কিন্তু তাই বলে তা কখনই গাজোয়ারামি বা তরল পরিমিতিহীন নয়। কথাবস্তুকে বহুস্তরিক করে তোলার জন্য অত্যন্ত জরুরি।’

 হালের বাংলা সাহিত্যে কিছু অলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অন্তত বদ্‌শব্দের বিস্তর পেষণচূর্ণন অর্থবদল ঘটেছে। কিন্তু বদ্‌শব্দ আর গঁবারু বা দেহাতি শব্দের মধ্যে তরতফাৎ আছে। তবে পাশাপাশি একশ্রেণীর সৃষ্টিশীল লেখক স্ল্যাং-এর সুপরিমিত ব্যবহার করছেন, সেটা সুলক্ষণ অবশ্যই। তা আদৌ কুরুচিকর নয়। এর ফলে বাংলাসাহিত্যের বাচ্চাদানি স্ফীত হচ্ছে। শব্দ ও কথার নতুন ধরন পালটে দিচ্ছে সাহিত্যকে। বর্ণ, ধ্বনি, টেক্সট আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যে ফুটে উঠছে প্রান্তিক ইশারা। রবীন্দ্র গুহ স্ব-কৃত স্ল্যাং-প্রযুক্তির একটি চার্ট পেশ করেছিলেন ‘শহর’ পত্রিকার স্ল্যাং সংখ্যায় (শহর-২৯, সেপ্টেম্বর ২০০৪)। সেটি এরকম:

বাংলা

চাষাড়ে শব্দ— মাগির গতরে খাটো বেলাউজ, সায়ার দড়িতে হ্যাঁচকা টান, বাসনা খাবুর-খুবুর, গুদমারাইন্যা।

খিস্তি— চশমখোর, হালায় ঢপ, নেড়িকুত্তা, চদু, সাউগিরি।

খেউড়— মাউগ, কামকেলি, আহার কপাইল্যা, ডব্‌কা।

বদ্‌বচন— নাঙ, লাং, লাইংগা, মারানাঙনাইছা, বুকমারানি, যোনিমধ্যে বিন্দুপাত।

 

হিন্দী

লিচ্চড়পন— শালো গাণ্ডু, ছাতি পর স্তনুয়া তিব্বে, বত্‌সুরৎ অওরত কসবিন। 

অনাপশনাপ— লুচ্চা, লুণ্ডমুণ্ড, গপোয়া, লম্পুজ ছোকরি, জংলী মুর্গী। 

অনগড়ন বুলি— ভড়কিলে গঁবার, বেঢঙ্গী কুতয়া, রাণ্ডি গঁবারনি।

কটুবচন— ঝুলতা স্তন, ছোড়না কূটকুলা, শালী বাতুনী।

 

রাজস্থানী

ডংকবচন— চিমটিভর অহ সোনি উড়মাল, গোদ মে চিড়িয়া ছুমছুম, হেম কলস কুচ জুগ হিয়ে।

লিচরপন— মারো তায়া গরম, অয়জী আও করে, শুরু অনবন লীলা, জোবন ফাটি তলবাড়ী। 

মহকবুলি— বিরছাসুঁ লৌকি মিলে, উর চৌড়ী, কড় পাতলী, আও তুঁটা মিলৈ। 

 

ছত্তিশগড়ি

ঝাটুয়াবুলি— তোর কন্‌হিয়া লটক জাঁউ, গোদনা গোদাউঁ তোহার, অয়ঁ অন্‌ঠন বিছুয়া।

জঁবারাবুলি— চুতর ফাটাকে নাচ্‌, কসবি, চুত তেরী মোতিঝালর। 

উড়াবচন/ পণ্ডুবুলি— তোর বিন মোলা বদন তরসহো, স্তনুয়া তোহার চিকনি মছলি, কামাতুরন আও ন ভয়ং ন লজ্জা।

 

পাঞ্জাবি 

জলজলুল— দুকড়ে অওরত রুখাসুখা, কঁড়িচোদ্‌ মক্‌খন জ্যয়সা, সুরবনিয়ো সোহাগিন পল্লু।

ললপলুল— চিকনি চোপরি লৌন্ডা, খিঁচকর মার, তঁয় বুড্ডা হো ক্যা, তেন্নু ফুন্‌দি, ঘুঁসাউ গন্না।

উগরদুগর— কুড়িয়া চুতর নাচনী, ওয়ঁ গুথানে আয়া, তুম্হারে চুল্লি স্তনুরা।

 

হরিয়ানভি

অন্‌ডবন্‌ড— ওত্‌তেরি উগলা খন্ডেমে ল্যন্ড, অয়ঁ ডোকরি খুট্টা মারু, বিড়িংপল মৎ কর্‌, পিল্লা-তিরিয়া।

খড়িয়াবুলি— শালো লিতোর, ছোরি তেরি খাই ঘোটি, চুতর বটরিন, অহঁ।

রঙরসিয়া— কুট কুট ফুটনা স্তনুয়া, শালী পত্থর বনজর হো, লুচ্চে বদ্‌গুমানী লড়কী।

রবীন্দ্র গুহ মনে করেন, সব ভাষাতেই অন্তরের ছোঁয়া, আবেগময়তা আছে। স্ল্যাঙে অতিরিক্ত শারীরিক ভঙ্গি তথা প্রাণোচ্ছ্বলতা বাঙ্ময় হয়। এতে খ্যাপামি যৌনকাতরতা চিত্তবিকার ক্রোধ-কোপ-রোষ থাকতেই পারে। উত্তেজনা ছাড়া যেমন কিছুই পয়দা হয় না, এসব ছাড়াও মহিমাময় চালিকাশক্তি হারায় মানুষ। অতঃ, মানদণ্ড অনুশাসন ফতোয়া পরোয়ানা জারি করে ভাষার এথনিটিকে খর্ব করা ও গতিক পারম্পর্যকে মুছে দেওয়া সমর্থন করা যায় না, অবশ্যই।

লেখক পরিচিতি:

অজিত রায়

সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষক, ধানবাদ, ঝাড়খণ্ড

ই-মেইল: ajitroyshahar@gmail.com

Array

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *