অগ্রন্থিত গল্প: ঋত্বিকের একচিলতে ভূগোল
র বী ন্দ্র গু হ
এখন এমন অনেক মানুষ আছে যাদের সঠিক শনাক্ত করা যায় না। ভুলমানুষ, কী ভালোমানুষ, কী মন্দমানুষ। ঋত্বিক এইরকম একটি মানুষ। সবসময় বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে চলে। ২১ বছর বয়সে, সে, ঋত্বিক ৩০ বছরের একটি মহিলাকে বিবাহ করে। মহিলাটি স্বামী পরিত্যক্তা। কিন্তু অঢেল পয়সাকড়ির মালকিন। সেই পয়সায় ঋত্বিক ফুর্তিফার্তা করত। অত্যধিক মদ্যপান করে নোংরামি করে বেড়াত। পুলিশ ধরত। বউ ছাড়িয়ে আনত। আশ্চর্য, বউয়ের সঙ্গে কখনো মনোমালিন্য হয়নি। দু’জনেরই মুক্ত আনন্দের জীবন।
সেবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। পাড়ার এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়ল। এখন-তখন যায়-যায় অবস্থা। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। ছাতার তলায় বৃদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে এলো। সারারাত বসে রইল দু’জনে।
ঋত্বিক বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিল। এ-জন্য যথেষ্ট লাঞ্ছনা সহ্য করতে হত। ক্ষমতাবানদের খুশি করতে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। খুব লাঠি-পেটা করল। ওপরওয়ালার হুকুমে সরকারি ডাক্তার দিয়ে মস্তিষ্ক ছানবিন করাল।
‘কী পেল?’
‘চ্যাংরাদের মস্তিষ্কে যা পাওয়া যায় সেরকম কিছু নয়।’
‘তবে?’
‘ভয়ংকর ক্রোধ— তিক্ত ইচ্ছাসকল— তীব্র উত্তাপ।’
‘এবার কী করবেন? ছেড়ে দেবেন?’
‘পাগল! এই তো সুযোগ খিঁচে নেবার। ওর বউটার বিস্তর টাকাকড়ি। আমাদের দেখুন, ৭ মাস ধরে ডি-এ পাচ্ছি না। ছেলেমেয়ের টিউশন-ফি দিতে পারছি না। তাও ৩০০০ টাকা বাকি। বউয়ের কাছে ধার ৯০৫০ টাকা। সরকারের কাছে টাকা নেই। সাহেবরা বলে, খিঁচে নাও—’
হাসে। ভুরু নাচায়। বলে— ‘ওর বউটা মালদার আছে।’
আরো কিছু বলেছিল। শুনে ঋত্বিক পুলিশের গলা টিপে ধরেছিল। তখন ওকে উলঙ্গ করে খুব পেটানো হল। সারা শরীর দাগড়া-দাগড়া হয়ে গেল। বউ টাকার থলি নিয়ে এসে ঋত্বিককে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। রাজনীতির লোকেরা এরপর ঋত্বিককে নিয়ে টানাটানি শুরু করল। ঋত্বিক রাজি হল না মর্গের ফাড়াইবাবু হতে।
বউয়ের বয়স যখন ৩৩ এবং ঋত্বিকের ২৪, তখন বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ২৪ থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত কলকাতায় হেন নিষিদ্ধপল্লি নেই যেখানে ঋত্বিক রাত না কাটিয়েছে। এবং বহু মেয়েকে ঘরে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে। তারা এখন সুখে ঘরসংসার করছে। এক পত্রকারের উৎসাহে এইসব মেয়েদের নিয়ে কিছু লেখালেখিও করেছে। সেই সূত্রে একটি পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে আলাপ। সে পড়াশুনাও করত, চাকরিও করত। তাকে বিয়ে করল। মেয়েটির বাড়ি তুরা, গারো হিলস্, মেঘালয়।
সে বিয়েও টিকল না।
কী একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়েটি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল। জিদ করে মাথা ঝাঁকিয়েছিল। ঋত্বিক ক্ষেপে গিয়ে তার মাথায় আঘাত করল।
রক্তে ভেসে গেল সারা শরীর।
পড়শিরা পুলিশে খবর দিল।
পুলিশ ঋত্বিককে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল—
‘এরকম একটা জঘন্য কাজ তুমি কেন করলে?’
‘জঘন্য কেন বলছেন?’
‘তাহলে কি ভয়ংকর বলব?’
‘আমি এসব মানি না।’
‘কী সব?’
‘এই জঘন্য বা ভয়ংকর বলা।’
‘এত রক্তপাত? এত বড় একটা ইম্মর্যাল অ্যাক্ট?’
‘এটা যে আমি-ই করেছি সে ব্যাপারে আপনারা কি নিঃসন্দেহ?’
‘আর কী হতে পারে?’
‘হতে তো কত কিছুই পারে।’
‘যেমন?’
‘ও আত্মহত্যা করেছে!’
‘তুমি একটা মস্ত ধরিবাজ। কী লিখব বলো?’
‘কত দিতে হবে?’
‘তিন পেটি—’
‘না, এক—’
‘দুই—’
‘রাজি।’
‘লিখলাম— আত্মহত্যা।’
তবু, সাত-সাতটা দিন জেল হাজতে থাকতে হল। ৩ দিন টালিগঞ্জ হাজতে, ২ দিন পাটুলিতে, ২ দিন যাদবপুরে। হাজাররকম জিজ্ঞাসাবাদ হল। এসবই টাকা দিতে বিলম্বের জন্য। শেষদিন বড়বাবু জানতে চাইলেন—
‘তুমি কি নিজেকে অসুস্থ মনে করো?’
‘না, মোটেই না।’
‘কখনো মনে হয় না তলপেটে চাপ? পিত্তথলি ফেটে যাবে?’
‘না।’
‘তোমার তো অনেক চাটুকার আছে?’
‘আছে।’
‘তোমার দ্বিতীয়পক্ষের বয়ফ্রেণ্ড ছিল?’
‘ওসব কথা থাক।’
‘না, সব আমাদের জানা দরকার।’
‘সমাধান তো হয়েই গেছে— দুই—’
ধরো তোমাকে ছুটকারা পাইয়ে দিচ্ছি, আবার তুমি এরকম করবে?’
‘কীরকম?’
‘এইরকম জঘন্য কুকর্ম—’
‘এসব না হলে আপনাদের কী হবে? ৭ মাস ডি-এ নেই, টানাটানির সংসার—’
‘থামো তো— তুমি একটি খাঁটি শয়তান।’
ঋত্বিক হাসল— ‘আপনি মহাছ্যাঁচোর— আপনার মত করে আমাকে ছাঁচে ঢেলে দেখছেন—’
‘থামো থামো। তোমার মত গাছ-হারামি অনেক দেখেছি। নেতা-মন্ত্রীরা আমার জুতো চাটে, জানো।’
‘জানি। আপনি তাদের চোরাই-মালের রাখোয়ালা। ঠিক কি না?’
‘এসব কথা—’
‘থোতাবেন না। হ্যাঁ অথবা না বলুন।’
‘ধমকাচ্ছ?’
‘জানতে চাইছি।’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। কারা আসছে।’
দুটি চ্যাংড়াকে কোমরে দড়ি বেঁধে আনা হল।
ছেলেদুটির জামাকাপড় ভেজা।
ঋত্বিক অবাক হয়ে বলল— ‘আরে তোদের এ অবস্থা কেন? গ্রেপ্তার করে জলে চুবিছে নাকি? খুব পিটিয়েছে?’
‘সে বড় জঘন্য ব্যাপার। থাক ওসব কথা। তুই এখানে?’
‘আমাকেও ফাঁসিয়েছে গাব্বুখেলায়।’
বড়বাবু তাজ্জব— ‘আপনারা মনে হচ্ছে চেনাপরিচিত?’
‘আমরা ফৌজে ছিলাম। রংরুট।’
‘তাই একইরকম চরিত্র! শালা জুঁনতু। ভরদুপুরে খিরকি ডিঙিয়ে খাপাতে গিয়েছিলে ভদ্রপাড়ায়?’
‘মিথ্যা কথা। ওটা বানানো গল্প। আমরা শ্যুট করছিলাম।’
‘পুলিশের লোককে বদনাম দিচ্ছ? বয়স কত?’
‘২৪ বছর।’
‘পুলিশের লোককে বোকা বানাচ্ছ? এইটুকুন বয়সে ফিল্ম বানাচ্ছ? এরকম কাজ কি এই প্রথম?’
‘কলকাতায় প্রথম?’
‘এর আগে কোথায় ছিলে?’
‘দিল্লিতে।’
‘থানায় রেকর্ড আছে?’
‘হয়তো আছে।’
‘হয়তো বলছ কেন?’
‘থানার সামনেই আমরা অনেক না-মানুষের শবদেহ শ্যুট করেছি। তাদের মৃত্যুকালীন আর্তস্বর রেকর্ডিং-ও করেছি। থানার সিপাইরা আমাদের গ্রেপ্তার করেছিল।’
‘কী ছবি শ্যুট করছিলে?’
‘মহামৃত্যুর—’
‘ছবির নাম?’
‘সি, হু কিল্ড মি—’
‘ইংরেজি?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাংলা বাংলা বা হিন্দি নয় কেন?’
‘সিনেমাটা শুধু বোকাদের জন্য তৈরি—’
‘কাদের তুমি বোকা মনে করো?’
‘অধ্যাপক— রাজনেতা— সরকারী আমলা।’
‘কেন, ওদের কেন বোকা মনে করো?’
‘কেননা, ওদের বোধ মানেই ভুসোকালি—’
‘ও ও ও।’ বড়বাবু কুরসিতে পোঁদ ঘষলেন। নিঃশ্বাস ফেললেন— ‘তাহলে পাব্লিককে কী বলবে? কাশিধামের গোরু?’
‘ঠিক তাই।’
‘আচ্ছা, আমাকে দেখে কী মনে হয়?’
‘পাথরের শ্লেট।’
‘কোনো মূল্যই দিলে না। দিল্লিতে যে ছবিটা শ্যুট করেছিলে তাতে কি হিচককীয় আতঙ্ক ছিল? ফিল্মের প্রথম শটটা কীরকম?’
‘বেশ জটিল। অনেকগুলো দৃশ্য চোখের সামনে— ট্রেন উলটো মুখে ছুটছে— বৃদ্ধ লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙছে— যুবতী যমুনা সাঁতরে যাচ্ছে— একটা নৌকোয় ছেলেমেয়েরা মুখোশ পরে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে— ফাঁকায় ফাঁকায় মৃত্যুর আর্তনাদ—’
‘ফিল্মটা তৈরি শেষ হয়েছে?’
‘না। হাসির শব্দের সঙ্গে আর্তনাদের শব্দটা মেলানো যাচ্ছে না।’
‘হুম্।’
ঋত্বিক বলল— ‘স্যার আপনি একটা ক্ল্যু দিন না। নেতামন্ত্রী আর পুলিশরা তো সব পারে।’
‘আপনার নাম রাখব। জম্পেশ হবে।’
‘ধুস্।’ বড়বাবু ধমক দিলেন। ‘যত্তোসব বমন-রহস্য গপ্পো।’
‘আপনি রেগে যাচ্ছেন স্যার। পুলিশের লোক রাগলে আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে— রবীন্দ্র সংগীত—’
‘থাম তো হে—’
ঋত্বিক হাই তুলল। হাসল।
‘লম্বা রুলের কুর্তা গায়ে একজন পার্টির দাদা এলো। বড়বাবুকে খুশি করার জন্য ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে ধমকে বলল— ‘কাজটা মোটেই ভালো করোনি হে! ভয়-টয় দেখাতে পারতে, কিন্তু—’
বড়বাবু কথাটা লুফে নিয়ে বললেন— ‘মাথাটা ফাটিয়ে দিয়েছে—’
‘নষ্ট চরিত্রের মেয়েছেলে। ঢঙি আছে। সবকথা বিশ্বাস করবেন না। ছেড়ে দিন। আমি সামলে নেবো— সামনে ইলেকশন—’
‘আমি তো হাত গুটিয়েই আছি। নীচের তলার ছেলেরা অ-খুশি।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সব হবে। এবার একটু হাসুন।’
কোর্ট যেতে হল না। থানা থেকে বেরিয়ে ঋত্বিক ভাবল একবার হাসপাতালে যায়। মিলির মাথাটা কতটা ফেটেছে স্বচক্ষে দ্যাখে। অপরাধ স্বীকার করে বলে— ‘আমি অতি নিকৃষ্ট খামখেয়ালি মানুষ। নষ্ট চরিত্রের। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’
‘বাব্বা, বেশ বলা হল তো! সবজান্তা বউ, সে মেনে নিল।’
কেঁদে ফেলল। সর্বনাশ, এবার তো ঘাড়ে চেপে ফের পিণ্ডি চটকাবে! ঋত্বিক ডাইনে যেতে বাঁয়ে ছুটল। চারপাশে কত মানুষ। কেউ ৬ ফুট লম্বা, কেউ ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। কেউ ৫-৫। কেউ উত্তরে যাচ্ছে কেউ দক্ষিণে। কেউ পূবে কেউ পশ্চিমে। কতরকম দায়দায়িত্ব নিয়ে ছুটছে। কেউ হাসপাতালে যাবে। কেউ কোর্টে। ডিভোর্সের মামলার আজ শেষ তারিখ। স্বামী-স্ত্রী তর্ক করতে করতে যাচ্ছে। স্বামী সিগারেট ধরাল, ফেলে দিল। মড়া নিয়ে শ্মশানের দিকে যাচ্ছে একদল লোক। ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে শীর্ণকায় এক কাবারিওয়ালা। হাঁপাচ্ছে। সামনে যানজটে আটকে আছে স্কুলের বাচ্চারা।
দুটি লোক গল্প করতে করতে যাচ্ছে। একজন বলছে— ‘প্রেম-ভালোবাসা খুব পুরাতন কথা, বুঝলে। আজকাল চলে না। এখন মানানসই কথা ‘পছন্দ’— ‘ভালোলাগা’—
‘তা ঠিক। যেমন আইনের সম্পর্ক কোন সম্পর্ক নয়— ভূতের খেলা— আসল সম্পর্ক হল পছন্দ অপছন্দের।’
‘হাজতে বৃদ্ধ কয়েদি। আর দ্যাখো মজা, আমি কেমন ফক্কি দিয়ে চলে এলাম— হেঃ হেঃ!’
ঋত্বিক হাসল। বুকে ফুঁ দিল। জিভটা তিন ইঞ্চি বেরিয়ে এলো। রাগ হল। রেগে যাওয়ার আনন্দও হল খুব। ‘শ্লা, লম্পট’… বলতে বলতে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে দৌড়ল।

আরও পড়ুন...
রবীন্দ্র গুহ-র সাহিত্য: একটি ভূমিকা
___আসানসোলে রেলোপলিস: এক সন্ত্রস্ত ঘরকুনোর অসমাপ্ত আত্মকথন
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়চল্লিশের সংকট, বাংলা কবিতা ও কিছু ভাবনা
সুনিমা ঘোষজীবনের ঘের থেকে মুক্ত পথে…
সব্যসাচী হাজরাজীবন্ত ক’রে তোলার হর্ষোল্লাস
সব্যসাচী হাজরাসাহিত্যের ম্যারাথন রেসে উড়োমানুষ রবীন্দ্র গুহ
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়রবীন্দ্র গুহ-র উপন্যাস ইহদিল্লি শহরনামা
সঞ্জীব নিয়োগীঅসভ্য কৃষকের অসভ্য কথা
কানাই চৌহানকুসুম, রাজবীরের চেয়ে বড় ক্রান্তিনারী
তৃপ্তি সান্ত্রারবীন্দ্র গুহ-র স্ল্যাং-প্রযুক্তি
অজিত রায়রবীন্দ্র গুহ-র সঙ্গে বোধপ্রবাহ বিষয়ক কিছু কথাবার্তা
আলাপচারিতায় অজিত রায়রবীন্দ্র গুহ-র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও গ্রন্থপঞ্জি
___মানভূমের ভাদু: নারীচেতনার প্রেক্ষিতে
ড. বরুণ মণ্ডল