রবীন্দ্র গুহ-র সাহিত্য: একটি ভূমিকা

প্রথমেই বলে রাখি— এই লেখা রবীন্দ্র গুহ সম্পর্কে কেবল মাত্র কিছু তথ্য। কলকাতা থেকে কমবেশি ১৬০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল নিমসাহিত্য আন্দোলনের শুরু। বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের শুরু। কয়েকজন তরুণ শুরু করলেন ‘না-সাহিত্য অল্প-সাহিত্য তিক্তবিরক্ত-সাহিত্য’। এর সূচনা হয় ‘নিমসাহিত্য’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। বিমান চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল বণিক, নৃসিংহ রায়, অজয় নন্দীমজুমদার, সুধাংশু সেন এবং রবীন্দ্র গুহ— দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার এই ছ-জন কর্মী শক্ত হাতে শুরু করলেন এই আন্দোলন। রবীন্দ্র গুহ তাঁদের একজন। তাঁর সাহিত্য প্রথাবিরোধী, স্বতন্ত্র। ডাইনামিক জীবনের কথার বাহক তাঁর কথাসাহিত্য। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘নিমসাহিত্য বেত্তান্ত’ তার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর গল্প উপন্যাস সম্পর্কে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেছেন “গোত্র-ছাড়া”। রবীন্দ্র গুহ-র প্রথম গল্প ‘জলটুঙ্গি’। তাঁর প্রথম দিকের কয়েকটা গল্প ‘রফা’, ‘জলটুঙ্গি’, ‘সাজা’, ‘লগরচানের ভিলাই দর্শন’ উল্লেখযোগ্য কাজ। তাঁর ‘চুক’ গল্প ভারতীয় সাহিত্যের সম্পদ। তিনি নিম সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ। তাঁর প্রথম তিনটা উপন্যাস ‘রাজপুতানার ইতিহাস’, ‘প্রেম আতঙ্কে সন্ত্রাসে’, ‘পদধ্বনি প্রতিধ্বনি’-তেই আত্মআবিষ্কারের বায়োস্কোপ লক্ষ করা যায়। চতুর্থ উপন্যাস ‘লোহারিয়া’ নামকরণে অভিনবত্ব আছে, ব্যতিক্রমী লেখার ইঙ্গিত রেখে যায়। রবীন্দ্র গুহর অধিকাংশ লেখাই ভারতীয় প্রেক্ষাপট বহন করে। বহির্বঙ্গের জীবন তাঁর সাহিত্যের উপাদান। যা অনেকটাই বাংলা সাহিত্যের ধারা থেকে ভিন্ন। ‘দহন’, ‘দ্রোহপুরুষ’, ‘মেবারের মসনদ’, ‘সূর্যের সাত ঘোড়া’, ‘নাভিকুণ্ড ঘিরে’ আর ‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’-এর মতো উপন্যাস আর ‘জন-মানুষ’, ‘সম্মুখে ফার্নেস’, ‘জৈগুনের পদ্ম’, ‘রবীন্দ্র গুহর গল্পের ভুবন’-এর মতো গল্পের সংকলন ভিন্ন ধরন এবং জগতের বাহক হিসেবে বাঙালি পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছে। একজন দূষণ সংক্রামিত লেখক নিজের বুকের নিরালা কক্ষ থেকে উৎসারিত সাহিত্যকেই লিখেছেন আজীবন। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমি দগ্ধ একজন মানুষ’-এ ভাঙাচোরা লেখার জীবনপ্রবাহ লক্ষ করি। স্মৃতিপ্রবাহ। এত এত অভিজ্ঞতা অথচ কোথাও অতিকথন নেই একটার পর একটা স্মৃতি যা প্রবাহ আর ভাষাকে ধারণ করে রাখে ২৭ পৃষ্ঠার বইতে। ছোটো অক্ষরের বিন্যাসে ঠাসা ছাপার বই। তাঁর ‘নাভিকুণ্ড ঘিরে’ পৃথিবীর প্রথম নিম উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপটও বহির্বঙ্গ। উচ্ছল যুবক-যুবতীদের জীবন। যুদ্ধ। বেঁচে থাকা। ক্রমাগত বয়ে চলা। রোমাঞ্চ। ভাষার ডাইনামিক্স। এবং মাঝে মাঝে স্মৃতির রোমন্থন উপন্যাসকে বিচিত্র মাত্রা দিয়েছে। জীবনের এই তরঙ্গায়িত রূপায়ণ ভাষায় এর আগে বাংলা সাহিত্যে হয়নি। এই উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় পত্রিকায় বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। বই আকারে প্রকাশ ২০০০ সালে। তাঁর উপন্যাস ‘সূর্যের সাত ঘোড়া’ আরও গভীরতম কাজ। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘শিখঞ্জের পাখি খামোশ’। তাঁর লেখা বঙ্গের ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক সামাজিক গণ্ডিকে অতিক্রম করে বার বার। ‘নাভিকুণ্ড ঘিরে’ উপন্যাসের ব্লার্ব পড়লেই তাঁর লেখার ডাইনামিক্স কিছুটা হলেও বুঝতে পারব আমরা। “যৌবনের ব্যাখ্যা নেই কার্যকারণের বাধ্যবাধকতা নেই নীতি-যৌক্তিকতা নেই যৌবন ডাইলেকটিক্যাল যৌবন অবস্তুবাদী অহরহ বুকের ভিতর স্বপ্নের ভিতর সুখের ভিতর দুঃখের ভিতর যন্ত্রণার ভিতর তৃষ্ণা নিয়ে ক্ষুধা নিয়ে ফুল নিয়ে শূন্যতা নিয়ে সুগন্ধিত নিঃশ্বাস নিয়ে নাভিকুও ঘিরে হিংস্র পরবশতায় দুর্ধর্ষ ছবিসহ দুঃসাহসিকতায় বাথায় মুগ্ধতায় মহিমায় রক্তধারায় চূড়ান্ত অনাত্মীয়তায় বন্যতায় সাধুতায় আঁতাতহীন ভালবাসায় উগ্র কুণ্ঠায় নাভিকুণ্ড ঘিরে নিদারুণ অজ্ঞতায় চিহ্নহীনতায় নিষ্ঠুরতায় নাভিকুণ্ড ঘিরে ভয়ংকার আর্ততেজে বোধোদয়ে প্রণয়ে লড়াইয়ে রাজনীতিতে অজস্র ধূলি-অণুতে ব্রহ্মরক্তে আমিত্বের লীলা চৈতন্যে আকাংখার চচ্চর রবে নাভিকুণ্ড ঘিরে অদম্য অসহ্য ঘৃণা পাপ ও অসহ্যতার মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে স্থায়ী হয়ে জয়ী হয়ে কবিতার মার্বেলের মত রোমান্টিক সৈনিকের মত লড়াইবাজদের মত ক্ষিপ্ত টালমাটাল শান্ত উদার বিনয়ী রাগী সহৃদয় বিভ্রান্ত যুবক-যুবতীদের নিয়ে রবীন্দ্র গুহর নবমূল্যায়ন।”… 

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *