জীবনের ঘের থেকে মুক্ত পথে…

স ব্য সা চী  হা জ রা

রস থাকলেই রসায়ন হয় না। তার জন্য দরকার ফ্রি আয়ন। যে পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা যাবে লেখার হাড়, মাস, রক্ত। তাতে প্রাণ দিয়ে তাকে জীবন্ত ক’রে তোলাই শিল্পীর কাজ, স্রষ্টার কাজ। রবীন্দ্র গুহ তেমনই একজন। জীবন্ত না ব’লে সেখানে জ্যান্ত বললে কথাটা যেন বেশি মাত্রায় আলোকিত হয়। সামগ্রিক ভাবে তাঁর ভাবনা ও লেখার বর্তনীতে তড়িৎ চলাচল হতেই থাকে। থামে না।

একটা লেখায় বলেছিলাম আমার অসমবয়সী অতি তরুণ বন্ধুদের মধ্যে তিনি একজন।

প্রথম যেদিন আলাপ—

— এসো এসো সব্যসাচী, প্রদীপ। তোমাদের কথাই ভাবছিলাম। বোসো।

— কেমন আছেন রবীন্দ্রদা?

— ফার্স্টক্লাস

 

ঝাঁ চকচকে স্মার্ট ৮০ ঊর্দ্ধ একজন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। দেখেই মনে হোলো জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়াটাকেও এই মানুষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারেন। তাঁর লেখা আর তিনি একই, মিলেমিশে একাকার। কোনো ওঠা নামার পরোয়া নেই। কোনো পরোয়ানাও নেই। আছে নিজের উপর নিজের অগাধ বিশ্বাস। ‘আমিই আমার রাজা’। এ বিশ্বাস আমারও। ভালোলাগা, খারাপলাগায় অকপট, জৈবিক উত্থান ও পতনের সমুদ্রে পরিশ্রমী এক একক কাণ্ডারি। 

ওহো! এই মানুষই তো ভালোলাগার, সাহস জাগানোর উৎসমুখ। যে বলতে পারে “লন্ঠনের আলোতে যেমন সমুদ্র দেখা যায় না, মাত্র দুটি চারটি কথা বলেও কোনো মানুষকে সম্পূর্ণভাবে জানা যায় না। একজন মানুষকে পুরোপুরি জানতে হলে তার চারপাশের মুহূর্তগুলিও জানতে হয়। তার ভাবনা-চিন্তা, আশা প্রত্যাশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ব্যথা-বেদনা, সঙ্গীহীনতার শরীক হতে হয়। ব্যাপারটি দুরূহ , কিন্তু এইভাবে যথার্থ সত্যের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব।” 

এই যথার্থ সত্য জানার তাড়না তাঁকে কী ভাবে পেয়ে বসেছিলো আসুন তাঁর লেখনবিশ্ব থেকেই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা শুনে নেওয়া যাক। তাঁর শুখা গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড—

“একদিন আমার এক ওড়িয়া বন্ধু এসে বলল ‘ক্ষুধা মানুষকে কি ভয়ানক মরিয়া করে তোলে, চল আজ তার একটা নমুনা দেখাতে তোমাকে—’  

সে আমাকে লোহা কারখানার পিছনে একটা বিশাল জলাভূমির নিকটে নিয়ে গেল। কারখানা থেকে গলগল করে জল এসে নামছে সেই জলাভূমির মধ্যে। জলের রং আলকাতরার মতো কালো, তার ওপর কাচপোকার মতো চিকচিক করছে তেল মবিল। ছোট ছোট বেতের ঝুড়ি হাতে নিয়ে সেই তেল-মবিল ছড়ানো আলকাতরার মতো কালো জলে ডাহুক পাখির মতো টুকটুক ডুব দিচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক মানুষ। তাদের মধ্যে মেয়ে আছে, শিশু আছে, বৃদ্ধ আছে। কিন্তু জলের তলা থেকে যখন উঠে আসছে তখন চেনা যাচ্ছে না কে পুরুষ, কে মেয়ে, কে শিশু, কে বৃদ্ধ। লোহা-কয়লা নিয়ে তারা ছুট দেয় ঠিকাদার রামচরিত মিশ্রের ট্রাকের দিকে। ফাঁকি নেই, ডান-হাত বাঁ-হাতে লেনদেন। নগদা-নগদ পেয়ে যায় প্রতি ঝুড়ি এক রুপাইয়্যা। টাকা নিয়ে ছুটে আসে, পুঁটলিতে গুঁজে রাখে, আবার ঝাঁপায়। উঠে আসে, চোখ জ্বলে, নিশ্বাস আটকে আসে, উবু হয়ে ঘনঘন ওয়াক্ টানে—

খবর নিয়ে জানলাম, মানুষগুলি এসেছে খরা পীড়িত অঞ্চল থেকে বাঁচার আশায়। রামচরিত মিশ্রের দয়ায় এখনো বেঁচে আছ, কিন্তু ফিরে গিয়ে আর বাঁচবে কিনা ঈশ্বর জানেন। আমার বন্ধু জীবন বলল— ‘এদের নিয়ে একটা গল্প লেখ’।” এরকম কত কত অবিকৃত অভিজ্ঞতা ভেতর ভেতর তাড়া করে তা রবীন্দ্র গুহ’র লেখা পড়লেই বোঝা যায়। কেন জ্যান্ত বলতে চাই তাও বোঝা যায় এই ‘ডায়াস্পোরিক দ্রোহপুরুষের’ লেখা পড়লে। কারণ তাঁর লেখার লিখিত রূপে ভাষার আঞ্চলিকতা তিনি সচেতন ভাবেই বহন করেন যা সামগ্রিকভাবে গল্প ও উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য ক’রে তোলে। যা তাঁর জীবনজার্নি ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল বলেই মনে হয়। যে পরিবেশ রচিত হয় তা যেন চরিত্রগুলোর সাথে হাত ভাত ও পাত মিশিয়ে থাকে। সেখানে বুনো, এলিট ব’লে কোনো ব্যাপার নেই। শব্দ সেখানে নিজের প্রয়োজনেই চরিত্রের মুখে এসে বসে অথবা রচিত পরিবেশে মালাবদল করে। কমলকুমারের কথায় ‘ম্যাসকুলিন ল্যাঙ্গুয়েজ’ তৈরির চেষ্টা।

দ্বিতীয় দিন—

—কী লিখছো ভাই! হাত মেলাও। (দু-একটি বই প্রথমদিন দিয়েছিলাম)

—ভালো লাগলো আপনার? (চমকিত হয়ে। এই বয়সের মানুষ আমার লেখা সম্পর্কে এই রি-অ্যাকশান দিচ্ছে, অবাক হয়েই…)

—রাধা, বাঁশি, ঘ্যানঘ্যানে প্রেম লেখায় এসবের দিন শেষ, ভেবেই ভালো লাগছে- ওহ! নাও এই বইটা।

—‘কেন লিখি কিভাবে লিখি’ বাহ! আপনার গদ্যসংগ্রহ

—হ্যাঁ হ্যাঁ অলোক বার করেছে ক্যাম্পাস থেকে-

—বাহ!  

খুলে দেখি ভেতরে লেখা ‘সব্যসাচী হাজরা

                            গুণমুগ্ধ

                                  রবীন্দ্র গুহ’

এই বিনিময় শুরু। নানান ব্যস্ততায় মুখোমুখি হবার সুযোগ সেভাবে না হলে সে ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব আজও গভীর। গড্ডলিকার বাইরে বেরনোর ইচ্ছে থেকেই যেন এই মানসিক যোগাযোগ।

এবার এই এলে-বেলেমির ঢিলে-ঢালা ছেড়ে কিছু কথায় আসি। ‘হাংরির’ খিদে প্রথম কার পেয়েছিলো এ নিয়ে জট যেমন কাটে না তেমনই নিমের দাঁতন কে বেশি চিবিয়েছিলো সেই নিয়েও কনুই মারা কম হোলো না। যাই হোক আমরা খাবো না চিবোবো এই ভাবতে ভাবতে ভবদা’র সাথে লুকোচুরি খেলি। তাতে আমাদের মজাও হয়। সময় কাটে। খোশ-গল্প খিস্তি খেউড় হয়। অনলাইন অফলাইন সর্বত্রই দেখা যায় কেউ বা মলয় পবনে কাত কেউ বা ঈশ্বরে ডুবেছেন। তেমনই নিম গাছের কাণ্ডটি কার সে নিয়েও কাটাকাটি বিস্তর।  

নামের মালিক কে সেই দিকে না ঝুঁকে আসুন মালিকানাটা দেখি।

ক্রমের বাইরে উপাদান নির্বাচন তাঁর নেশা, অবিকৃত অভিজ্ঞতাই তাঁর কাছে সাহিত্য। তাঁর লেখা পড়লে বোঝা যায় এই উপাদান তার খোঁজ থেকে নয় তাঁর সঙ্গ থেকেই সঙ্গী হয়। তাঁর বহুমুখী চলাচল ও দেখার চোখ এমনই। তাঁর কর্মজীবন এতটাই রসদপূর্ণ।

দীপঙ্কর দত্তের সাথে রবীন্দ্র গুহ’র কথাবার্তায় আমরা যা পাচ্ছি ১) আমার লেখায় নির্মাণ ও নির্মিতির ব্যাপারটাই মুখ্য ২) বিস্তর ভাবাবেগ ও পুলক নিয়ে আমি কখনই লিখতে বসি না। ৩) ফন্দিফিকির ভুলে ভাবাবেগ ও ভালোবাসার অকৃত্রিমতা নিয়ে এগোলে একে অন্যকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। ৪) ব্যক্তিগতভাবে আমি চিত্রধর্মী শব্দ পছন্দ করি। হতে পারে তা আটপৌরে বাতিল জল-জঙ্গলের শব্দ, যা আমাদের চারপাশে প্রতিদিন জন্মায়, কিন্তু যত্নে লালিত হয় না। নিপুণতার সাথে সেইসব শব্দ গল্পে ব্যবহার করলে উপাদান জীবন্ত হয়ে ওঠে।… এরকম আরও কিছু।

অনেকেই লেখে। বাংলা ভাষায় লেখে। কিন্তু নিজের লেখাকে প্রকাশ করতে নিজের ভাষাপথ তৈরি ক’রে নেবার চেষ্টা বা পরিশ্রম খুব কম জনই করে। দু-একজনই এই এক ভাষার মধ্যেই নিজের সচেতন প্রয়াসেই তৈরি করে নিজের ভাষা। যেমন দীর্ঘদিনের গড্ডলিকা কাটিয়ে একদা কমলকুমার জেনে বুঝেই সেই ‘হাড়িকাঠ’-এ মাথা দিয়েছিলেন। খ্যাতি, লোভ, এবং গণপাঠকের হাত্তালি থেকে বহু দূরে পরীক্ষা ও নিরীক্ষায় বুঁদ হয়েছিলেন। ‘লেখকের লেখক’ ব’লে তাকে একপ্রকার না বুঝেই দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন কেউ কেউ। সেই ‘দুর্বোধ্যতা’-ই কি হোলো আমাদের অহংকার? প্রচল ভাষায় যে লেখক আঘাত করবে সেই করবে নতুনের আয়োজন। শিল্পী হয়ে ওঠার লড়াই সেখানেই। একজন মানুষের কতটা নিষ্ঠা থাকলে তৈরি হতে পারে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র ভাষা তৈরি হতে পারে ‘সুহাসিনীর পমেটম’। কী বললেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়? যদিও এই পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারটা ব্যক্তির উপর।বঙ্কিমের দীর্ঘদিন পরেই কি এই ধাক্কা? যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে থাকবে। খুব বেশি উদাহরণে যাবো না এবার সরাসরি ঢুকে পড়বো প্রচণ্ড অস্থির করে দেওয়া একটি লেখার ভেতরে। আমি অস্থির হতে ভালোবাসি। ভেতরে কেউ নাড়া না দিলে ভেতরে ভেতরে কেউ সাড়া না দিলে সে লেখা বেশিক্ষণ পড়া যায় না।

‘দুঁহু, দুঁহু’, ‘অঙ্গ-হ্রী’, ‘চিলম্ চিলম্’, ‘হিক্ হিক্’, ‘ইকঃ’, ‘আঁউ আঁউ’, ‘ঘিয়োঁ ঘিয়োঁ’, ‘ঘোঁৎ ঘোঁৎ’, ‘বোয়াঁ বোয়াঁ’, ‘হোই-হা-হা-হুররর্’, ‘ইঃ ইঃ’, ‘অয়ঁ অয়ঁ’, ‘হ্যঁ হ্যঁ’, ‘উঁ উঁ’, ‘উও-উও-উও’, ‘চুচুক্ চুচী-চুচুক্ চুচী’, ‘ববম্ বোম্, ববম্ বোম্, রম্-ঝম্ রম-ঝম্’, ‘চিঁহি চিঁহি’, ‘অহ অহ, অহ অহ’, ‘ঘুস ঘুস্ ঘুস্’, ‘ঝাঁ ঝাঁ’, ‘পঁ পঁ’, ‘চিঁই-চিঁই’, ‘পুটু-স, পুটু-স, ডান-খসা’, ‘কিস কিস কিস কিসঁ, ‘কঁঅ কঁঅ’, ‘আই ইকিঃ কীঃ’, ‘উষষ্ উষষ্’, ‘ফঁস ফঁস’, ‘শোঁ শোঁ’, ‘উউহ্-উউহ্’, ‘ভউঁ ভউঁ’,‘অঁঅ আঁয়’, ‘হিস্ হিস্’, ‘খ্যালপ্ খ্যালপ্’, ‘ওয়া-ওয়া ওয়া-ওয়া’, ‘হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ’, ‘ঝাগুড়গুড় ঝাগুড়গুড়’, ‘ঘোৎ ঘোৎ’, ‘অঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁ’, ‘খ্যালাক্ খ্যালাক্’, ‘ওক্ ওক্’, ‘আঁ আঁ’ … ও হো হো হো হো…কিছুই বাদ যায় নি বোধ হয়। একটানা পড়তে থাকুন। ধ্বনিময় ঈশ্বর, ধ্বনিময় শয়তান, ধ্বনিময় জন্ম, ধ্বনিময় মৃত্যু, ধ্বনিময় হাসি, কান্না, খুন, জখম, জাঁক, যৌনতা, ধ্বনিময় পশু, পাখি, কীট পতঙ্গ… ধ্বনিময় হা হা হি হি হু হু ধ্বনিময় খুটিমুটি, গোঁত্তা, খিস্তি, হাহাকার… ধ্বনিময় আপনি-আমি লেখক-পাঠক… 

চুপ্ কর শালা… তো এই দিয়েই শুরু ‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’। এই তার নির্মাণ পর্বের দিক। এই তার হূর্ত হূর্ত মু ও বাজানোর গুণ গুনা…  

“আমার কোন কোন গল্পে নাকি যৌনতার ছড়াছড়ি। বড় বেশি ক্রোধ হিংসা অশুভকর দৃশ্য। আমি শুনে খুশি হলাম। কেননা আমার বড় লেখায় এইসবই থাকবে। কেননা, আমি লিখব জাঠ গুজার যাদব চুড়াচামাড়দের দ্বন্দ্বের কথা, লোভলালসার কথা, তৎকারণ খুন্ননের কথা, নির্ব্যাজ প্রেমমত্ততার কথা। কেননা, আমি বুঝতে শিখেছি, তেজ, উষ্ণতা, উগ্রতা হরিয়ানভি মানুষের চরিত্রে ভারতবর্ষের যে কোন প্রান্তের মানুষের চেয়ে বেশি। এখানকার নারীপুরুষদের দৈহিক আকার গঠন, লিপ্সা, লোভ ভিন্ন।”

এই অনুসন্ধান থেকেই ভাষা আসে। প্রয়োজনের আলোতেই ব’সে যায় প্রান্তিক মানুষদের মুখে। চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। দেখতে পাই। আমি, আপনি হয়ে উঠি। সম্পূর্ণ অন্য এক যাপনে ব’সে ওই মানুষগুলোর যাপন দূরের বিস্ময় ব’লে মনে হয় না। এখানেই সার্থক তাউ দুধা সিং, দিগ্বিজয়, রাধাজী কিংবা মন্নু। প্রত্যেকেই নিজের নিজের জীবনে আনসেটলড, সবকিছুর মধ্যে থেকেও এক সর্বগ্রাসী শূন্যতা। অস্তিত্বের লড়াই, অস্থিরতার ঘুটঘুট, ক্ষমতার প্রতিফলন, আশা হতাশার লিঙ্গোত্থান। ‘রন্ডড়ে দোলন’, ‘উদভট্টি’, ‘রসিলা মন’, ‘আলোর ঝিরণি’, ‘খাটারা ট্রাকটার’, ‘উছলকুঁদ’, ‘ধুমক্কর’, ‘গুংগার মুখ’, ‘সাংকালীন মটমেলী চাদর’, ‘খনখনাহট্’ ‘হরাভরা’, ‘ললছৌঁয়া, ‘চিতরেফটা’ এরকম বহু আঞ্চলিক শব্দ বা শব্দগুচ্ছের সাথে অবলীলায় মিশে যাচ্ছে ‘অনন্ত আকাশগ্রন্থি’, ‘বিহ্বল প্রান্তর’, ‘যারপরনাই নয়নসুখ’,’মলিনবসনা দুখিনি’, ‘মোক্তিক নভমন্ডল’, ‘তমিস্র স্রোত’ ‘বিস্রস্ত বস্ত্রসকল’–এর মতো কত কত… এক অখণ্ড ধারার মতো মিলেমিশে লেখার রসায়নে যুগপৎ একই শরীরে বইছে। এই দীর্ঘ লেখার দু-একটি জায়গা ছাড়া তেমন কোনো পতন চোখে পড়ে না। এছাড়াও আছে ভাষা স্রোতের এই মুখে তৈরি করা অসংখ্য জোট শব্দের মজমজার হাট। জাঠ, গুজার, যাদব, আর চুড়াচামাড়দের লোভ, রাগ, হিংসা, ক্ষোভ, আমোদ, প্রমোদ, ঢলঢলানির মুখে লাগাতার চুটপুট, ছটপটানির বিশুদ্ধ শব্দহুল যেমন ‘সালু’, ‘ভেড়িয়া’, ‘ইতর’, ‘মাগী’, ‘ভ্যানকা চুত্’, ‘গাঁড়’, ‘হারামী’ , ‘কুত্তার বাচ্চা’, ‘চুতরপে লাথ্’, ‘কুড়িরচোদ’, ‘শালী, চোরনি’, ‘কুতিয়াঁ, ‘ফুটপাতিয়া’, ‘ঘনচাল’, ‘দুধিয়া’, ‘রানীচ্চুত’, ‘কুক্কুরি’, ‘পথের বেশ্যা’… এই শব্দগুলো প্রয়োগে কোথাও অশ্লীল নয়। আর অশ্লীলতা ব্যাপারটা আপেক্ষিক, এও এক মানসিক ঘের। এদের আলাদা ক’রে দেখলেই প্রকট হয়ে পড়ে। রসায়নের গুণাগুণ তাদের মিশিয়ে দ্যায়, তারা প্রয়োজনে আসে। অকারণে জেগে থাকে না। শিল্পিত হতে দেখি মনমরু ও জঙ্গলমন, হলুদ ও সবুজের অন্তঃক্ষরা ও বহিঃক্ষরা। 

‘পাহাড়ী জঙ্গলমুলুক’, শীতে ‘হাঁড় কাঁপানো বাতাস’, কখনো ‘ধূলোর ঝড়’, ‘বাতাসের ঘুর্নিপাক’, ‘শিসম সাইতুস’, ‘ভাটতিতির-বাবুই-লালমুনিয়ার ভয়ার্ত চিৎকার’, গ্রীষ্মের কর্কশ, পাণ্ডুর আকাশ, উড়ন্ত ধূলাভষ্ম, শ্মশানতর রোদের উত্তাপ, ‘চাংড়াস্ফীত ধূলামাটির ঢাঁই’, রুক্ষতা, বৃষ্টিহীনতা, ‘ঝামরানো বাবুলের ঝাড়’, ‘হরিৎকপিল টিডপতঙ্গ’, ‘শূন্য গোয়াল-বাথান’, ‘আঁকড়ে-কুঁকড়ে থাকা শস্যক্ষেত’, চিল, শকুন, কাক, কুকুর-বিড়ালের কান্না, পাহাড়ী পথে ‘ঝামরানো লতাঝোপ’, ‘বিষাক্ত কুড়াকীট’, ‘নাক-বাঁকা লেজ-উঁচু বিছা’, ‘নাম-না-জানা সরীসৃপ’, ‘দলা দলা লাল পিঁপড়ে’, বের-কাঁটার ঝোপ, এদিক ওদিক বিচ্ছিন্ন কিছু ময়ুর, সুখের বা সখের পাখি কোথাও নেই, নেই নীল অঙ্গিয়া, তালচোচা, ধনেশ, মাঠ চড়াই, সর্বত্র শ্মশানস্তব্ধতা, বাদামী লতা ঝোপের মধ্যে কখনো বা তিত্তির, পানিকাক, মেটে খরগোশ, ‘মস্তমোটা কীটপতঙ্গ, নীলকালো পাথর রঙ, লম্বা শুঁড়, কাঁটার মতো ক্ষুদে ক্ষুদে পা’, কখনো শালিক পাখি, ‘সদ্য পালক নির্মোচনের পর একটা গিরিয়া পাখি’… এই পাখ-পাখালি, কীট-পতঙ্গ, গ্রাম ও তৎসংলগ্ন পরিবেশ, প্রকৃতিকে লেখক যেন ক্ষুধার্ত, জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত, অবহেলিত মানুষগুলোর যাপনের সাথে বাস্তবিক এক অসামান্য দক্ষতায় মিশিয়ে দিয়েছেন।    

‘থলোস্তন’, ‘দেহের সমস্ত গড়নশোভা যেন বুকে কেন্দ্রায়িত। যা আঁটপিঠে কামিজে আঁটেনা’, ‘উবড়ানো স্তন’, ‘উথলানো বড় বড় গোলস্তন, ‘স্ফীত-স্তন’, ‘তাজা তরমুজের বিশাল স্তনদ্বয়’, ‘হরিৎবর্ণ বেলস্তন, নিটোল পদ্মের মতো, বৃন্ত বিচ্ছুরিত’, ‘বুকের অনেকটা অংশ বেলুনের মতো উবলানো, মসৃণ দুধে-আলতা রং’, ‘মোটা স্তনের বোঁটা, উষ্ণ রগছোঁয়া’, ‘উবলানো স্তন-বাঁধুনি’, ‘দুর্বৃত্ত বুকের দুলুনি’, ‘মোটা-খাড়া স্তন’, ‘হাটপাট খোলা মুক্ত ঊর্দ্ধাঙ্গ’, ‘সুডৌল স্তন’, ‘উবড়ানো বুকের শোভা’, ‘থলথলে মস্ত দুটি স্তন’, ‘কাঁঠাল জামের মতো উদলা বুক’, ‘বিরাট স্তন’, ‘উবডানো স্তন’, ‘আব্রুহীন বুক’, ‘উভরে পড়া স্তন’, ‘বস্ত্রহীন বুক’, ‘বিরাট স্তন উঁচু করে ঠেলে তোলা’ এভাবেই একে একে উপন্যাস জুড়ে কখোনো মহিষানীর কখনো বা মেয়েদের বুকের গঠন দিয়ে সৌন্দর্য, পুরুষের লোভে, কামবোধে মেয়েদের স্তনরূপ কখনো বা শূন্যতা কখনো সব হারানোর যন্ত্রণায় স্তন বা স্তনুয়া বা দুদু যেন জীবনের মুখ হয়ে উঠেছে।   

কুয়ো পুজো, ধনত্রয়োদশী উৎসব, ফুলসাজের উৎসব, নরসিংহের মেলার উৎসব ও হিরণ্যকশিপু বধ… মানুষের সুখসময়ের উল্লাস, তাদের জলময় জীবনের হাসিউড় বুদবুদ্, সে সব আজ স্বপ্ন… তারা নেই, তারা কোথাও নেই, বৃষ্টির জন্য, মেঘের জন্য সর্বাঙ্গে হাহুতাশ।

ফসলের মধ্যে কোথাও কোথাও মুসুর, মকাই, বাজরা, গেহুঁ।

জ্বালা সীমাহীন, খিদের জন্য, কামনার জন্য, লোভের জন্য, আশ্রয়ের জন্য, প্রকৃতির রোষের জন্য, ক্ষমতার জন্য, প্রতিপত্তির জন্য, দখলের জন্য, হারানোর জন্য, প্রিয় মানুষকে বাঁচানোর জন্য। দল গড়ে, দল ভাঙে, মানুষ, একা হয়, ভালো থাকার ভান করে, এক যন্ত্রণা থেকে বেরতে পারবে ভেবে আরেক যন্ত্রণায় ঝাঁপ দেয়।ক্রোধ, হিংসা, লালশা, দম্ভ, ক্ষোভের থুথু ছিটকোতে থাকে, লাল গড়িয়ে আসে। 

থান-তবেলা অথবা নহরখানা অথবা গিতোয়ার অথবা ঘের যে নামেই ডাকি চরিত্র সেখানে দুধা সিং: কল্পগাঁথায় বিশ্বাসী, বহুবিবাহে, বংশীয় দম্ভে, ক্ষমতা বিস্তারে, বিকারগ্রস্ত কামের এক প্রধান মুখ। নাতনীর শারীরিক উষ্ণতাও তাকে উত্তেজিত করে। নাতনীর বয়সী স্ত্রী রাধাজীকে সে ভোগ করে আবার বাইরের নারীসঙ্গে সে তার শরীরে বহন করে গোপন রোগ। সে তার সংসারহীন সংসার নিয়ে কখনো নিশ্চিন্ত কখনো উচাটন। পাহাড় সিং-এর মতো ছেলে(ছোট ছেলে) আর দু-একজনকে বাদ দিলে তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল পহেলবান বজ্রভূষণ যে তাঁর হুকুমের ফসল তুলতো। আবার এই বজ্রভূষণ দুধা সিং এর অলক্ষ্যে রাধাজীর সাথে তারই ঘরে কামক্রীড়ায় মত্ত। দুধা সিংকে খতম করার চক্রান্তের অংশীদার। আর এ ঘনটার সাক্ষী মন্নু। এই মন্নু চরিত্রটি অসাধারণ। তার একদিকে রাধাজী অন্যদিকে লাজবন্তি তথা লাজু। রাধাজীর লালজামার ভেতর বুকের দোলন দেখে তার বীজ লিঙ্গ কঠিণ হয় আবার গুহার মধ্যে লাজবন্তির কাম ইশারায় সাড়া দিতে পিছ পা হয়, লাজু ব’লে ওঠে “ক্যায়সান আদমি তু? ধ্যাৎ”। মন্নু চরিত্রটি পড়লে বোঝা যায় সে তার অবহেলিত লাথখোর জীবনের বিরুদ্ধে নিজের পৌরুষ জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দ্যাখে। এক মন্নু আরেক মন্নুকে দ্যাখে। কিন্তু নিজের বাসনা, কামনা তার অধরাই থেকে যায়।প্রতিটি ক্ষেত্রেই অন্যায়ের মুখে তার সেই অসহায় অবস্থা প্রকট হয়ে ওঠে।

তিনটে জায়গা উল্লেখ করি 

১। রাধাজীর বুকশোভা দেখে মন্নুর বীজলিঙ্গে শাবলের কাঠিন্য ও ধার।

২। বজ্রভূষণের লিঙ্গস্থলে লাথি কষিয়ে মন্নুর দৌড়ে পালানো।

৩। তাউ দুধা সিং ও পাহাড় সিংএর বস্ত্র টেনে নেবার পর দ্যাখা যায় লকপকে পুরুষাঙ্গের মুখে জলের রেখা।

প্রথম দৃশ্যে মন্নুর কামোদ্বেগ, দ্বিতীয় দৃশ্যে ভয় ও জড়তা থেকে নারীসঙ্গ না পাওয়ার ব্যর্থতাজনিত রাগ সম্ভোগকারী অন্য পুরুষের বিরুদ্ধে, তৃতীয় দৃশ্যে বাপ বেটার সেই লিঙ্গেই ভয়জনিত লকপকানি ও জলরেখা। আহা! দুর্দান্ত এই উপস্থাপনা।

পথের সিং, পাহাড় সিং দুধা সিং-এর দুই ছেলে। পথের সিং এর চরিত্রের থেকেও এখানে উল্লেখযোগ্য পাহাড় সিং। সে তার বাপের প্রশ্রয় ও আহ্লাদের এক উপযুক্ত বুদবুদ। মানুষ থেকে মহিষ কেউই তার কাছে আলাদা নয়। পাহাড় কাটায় মানুষ, দুধ দেওয়ায় মহিষ, শেষ পর্যন্ত উপার্জনের কল। নবীনা মহিষের মুখ ফাঁক ক’রে মদ খাওয়ায় বেশি দুধ পাওয়ার আশায়। নিজেই মদ্যপ অবস্থায় নাচতে থাকে মহিষদলের সাথে। মহিষের ঠমক, ঝুমকা স্তন দেখে উত্তেজিত হয়ে ‘নাল গৌরী নাল গৌরী’ ব’লে খেলা করে।

পুরো উপন্যাস জুড়ে মেয়েদের ভূমিকা বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ধরা পড়ে। রাধাজী, কৌশল্যা, কুন্তী, রোহিনী, নয়নাবাঈ, সরযূবাঈ, লাজবন্তি… রাধাজী ঘেরের ভেতরে ছটপট করে। ঘেরের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হতে সমস্ত শৃঙ্খল ভাঙতে চায়।বদ্ধ খাঁচা থেকে সে বেরিয়ে আসতে চায়, অন্য পুরুষের সাথে সঙ্গ করে, প্রতিবাদ জানায়। তার হাঁটা চলায় ঝ’রে পড়ে পুরুষশাসিত নহরখানার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনা, ক্রোধ। অন্যদিকে কৌশল্যা দিগ্বিজয়ের পাশে দাঁড়ায়।সে লোভ ও লালশার বিরুদ্ধে, দখল ও নোংরামির বিরুদ্ধে যেন একা এক জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি। সবাই শহরে চ’লে গেলেও সে নিজেদের মাটি আঁকড়ে রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না। সে কখনো ধনিরামকে বলে “গাঁয়ের অর্ধেক লোক ভিটে ছাড়া হল, শুধু গান বাঁধলে তো হবে না, বুদ্ধি দিয়ে কিছু করো”, কখনো বলে “দ্যাখো, সাপের মুখেই পড়ো আর বাঘের মুখে, আত্মরক্ষার জন্য হুংকার তোমাকে দিতেই হবে, নইলে বেঘোরে মরবে”, আবার সবাই যখন শহর থেকে নতুন ক’রে বাঁচার আশায় ফিরে আসছে তখন কৌশল্যার ভয়ার্ত গলা থেকে বেরিয়ে আসে “সেই এলে তোমরা, এত দেরি করে এলে!” কখনো গ্রামের ভয়াবহতা বোঝাতে সে শোনায় কিষণকাকা আর লাদুফুপির ঘটনা। যার পরিণতি, বর্ণনা, বিভৎসতা আমাদের বাকরুদ্ধ করে, শঙ্কিত করে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে সেই ঘটনার ভয়ঙ্কর নির্মাণে। কুন্তির জীবনও ভাঙাচোরা। সে ভোগ ও ভাগের শিকার। দিগ্বিজয় তাকে খুঁজে পায় রানিমন্ডির বেশ্যাপাড়ায়। আর পাঁচটা জায়গার মতোই সে এক দালালের খপ্পরে পড়ে।তাকে বিক্রি করা হয় তিন হাজার টাকায়। কখনো বংশীলাল, কখনো সুখলালজী, কখনো গঙ্গারাম, নতুন নতুন পুরুষের কাছে একঘেয়ে কামেচ্ছার বলি সে। এভাবেই একদিন সে নিখোঁজ হয়, এবং রোহিনী নামক একটি মেয়ের কাছে শোনা যায় তার গর্ভমাস চলছিলো, এবং এভাবেই একদিন লোভ, ষড়যন্ত্রের মুখে প’ড়ে বস্ত্রহীন কুন্তিকে দেখা যায় জ্বলন্ত অবস্থায় ছুটতে। সেই কুন্তী, কিন্তু এ উত্তাপ সূর্যের নয়, এ উত্তাপ হিংসার, ক্ষমতার, প্রতিশোধের। লাজবন্তি ওরফে লাজু দুধা সিং-এর নাতনী, চপল, চঞ্চল অনেকটাই বেপরোয়া। তার হাসি, দেহের গড়নশোভা, তার চলনে, বলনে এক তরঙ্গ। দুধা সিং তাকে দেখে ভাবে এ টিয়া না চৈত্রকোকিল।উপন্যাসের অতিরিক্ত-৪ পর্বে যখন লাজবন্তি দ্যাখে মন্নু একটা কাটড়া মোষকে বাগে আনতে আড়ে হাতে লড়ছে তখন সেই মোষটিকে বেঁধে ফেলায় তার যে ভূমিকা তা সত্যি আমাদের অবাক করে। এবং ঠিক তার পরে মন্নুর সাথে তার বাকিটা সময় কাটানো যে ভাবে বর্ণিত তা তাকে প্রকৃত সাহসী, বেপরোয়া, বললেও অত্যুক্তি হয় না।খানদানি রক্ত তার শরীরে। সে পহেলবানের ভয়ে ভীত নয়। বনঝোপের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওই বয়সেই সে প্রকাশ করেছে নারী-স্বাধীনতার কথা। মন্নুকে সে ভালোবাসতো। রোহিনী মুচি টংকারামের মেয়ে। সেও বাবুদের লোভের শিকার।অনাহার, দারিদ্রতা সত্ত্বেও তার আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল।বাবুদের চকচকে চোখের বিরুদ্ধে তার ঘৃণাভরা দৃষ্টি প্রকট। কুন্তির নিখোঁজ হওয়া সে মেনে নিতে পারে নি। হরিয়ানভি কুলিমজুরের যে দল আয়ানগরে কাজের জন্য এসেছে তাদের মধ্যেই একজনের সঙ্গী হোলো রোহিনী। তার নাম সরযূবাঈ। জীবনযুদ্ধে লড়াকু আরেক নারী।তার জীবনও অনেক ধুলো-ময়লা পার ক’রে আরেক পরিণতিতে উজ্জ্বল। চোরনি সন্দেহে তার কপালে লেখা হোলো ‘জেবকাটরি’। এইসব চরিত্রের সাথে সাথেই উপন্যাসের আরেক নারী চরিত্রে ফুটে ওঠে মাতৃত্ব। সেই চরিত্রের নাম নয়নাবাঈ। তার সঙ্গে দিগ্বিজয়ের দ্যাখা বনজারাদের ডেরায়। দিগ্বিজয় যখন তাকে প্রশ্ন করে “আপনার কাছে এত পুরুষ আসে কেন?”। উত্তরে নয়নাবাঈ একখানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দিগ্বিজয়কে বলে “আয়, আমার কাছে আয়”, তারপর কোলের কাছে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে বুকটাকে চেপে ধ’রে বলে “ম্যাঁয় তেরা মাঁ কা সমান, ই বাত ন জানু তু” বলতে বলতে দুচোখে জল।— এই অংশটা আমাকে পাঠক হিসেবে রোমাঞ্চিত করে। আবার এই পুরুষশাসিত সমাজেই বিভিন্ন জায়গায় নারীদের প্রতি অবমাননা চোখে পড়ে। গাঁওবুড়োদের কথায় “একটা মেয়েমানুষ, হঁ, একটা মেয়েমানুষ কী? তার জরুরত সংসারে কতটুকু? দুশমনের সাথে লড়তে পারে? পাহাড় ডিঙোতে পারে? কী পারে, না বাচ্চা পয়দা করতে পারে। সাচ্ কহো তো, একটা মেয়ে মানুষ আজ আছে, কাল নেই। এই ধরো, ছেঁড়া কামিজ-পিরানের মতোই। আচারে-বিচারে গন্ধেগী। লোভের পিন্ড।” আবার কখনো বলে “নারী শুধু ভোগ্যবস্তু”। পুণ্যে, পাপে নারীদের ভূমিকাকেই দায়ি করে এই পুরুষশাসিত সমাজ। কুসংস্কার, অন্ধত্ব থেকে জন্ম নেওয়া আচারে নারীদের দাঁড় করায় শিখণ্ডীর মতো।জীবন বাজি রেখে তারা হেঁটে যায় মাথায় প্রদীপ নিয়ে বৃষ্টির আশায়। পুরুষদের ভুল নিশানার বলি হয়। অথচ সমাজের বিশ্বাস টলে না। অন্ধকার মরে না। তাদের কথাতে পুরুষ, নারীর বিভেদও প্রকট হয়ে ওঠে— “পুরুষ হচ্ছে বিধাতার অংশ। তার শরীর আলাদা, বাসনা পূরণের পদ্ধতি আলাদা। তার বিচার বুদ্ধিতে কখনও ভুল হয় না। সুতরাং নারীর সঙ্গে তার তুলনা কী?”। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এই ভাবনাগুলো এতটাই মজ্জাগত যে পুরুষ, নারী সবাই খুশি। এই জায়গা আমাদের আরও বিস্মিত করে। “চক্ষে যদি থাকে আবির বাহার, বুকে বসন্তের ছোঁয়া, পুরুষ সব বয়সেই যুবক।”   

এবার আসি দিগ্বিজয় ও ধনিরাম প্রসঙ্গে। দিগ্বিজয় যেন যুগপুরুষ। তার গায়ে ‘বারুদগন্ধ’— আর এই নিয়েই তার এই লেখনভূমিতে প্রবেশ। প্রতিবাদ তার জীবনের অঙ্গ। সংঘর্ষের মুখে তার প্রজ্জ্বলন। তার বহু অভিজ্ঞতা, জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে সে দেখেছে বিভিন্ন ধরণের মানুষ, তবু একা তার জীবন। দেশে ফেরার আগে সে যখন নয়নাবাঈ-এর সাথে দ্যাখা করতে এলো, সে তাকিয়ে দেখলো সর্বত্র ব্যথার চিহ্ন। এই ব্যথা যেন তার বুকেই বেজে ওঠে। সে যেন অন্ধকার থেকে মানুষের উদ্ধারের জন্য ব্রতী। সে যখন বলে “নাহী-হম্ কদা কহী নাহী যায়েঙ্গে। হম্, ইঁহা রহেঙ্গে”। শুরু থেকে তার এই লড়াই-এ সে দু-একজনকেই পাশে পেয়েছে। কিন্তু কখনো দ’মে যায় নি। বরং হতক্লান্ত মানুষদের প্রতিবাদের মুখ হয়ে সে তার সংগ্রাম চালিয়েছে। কৌশল্যা আর ধনিরাম এরাই তার বন্ধু তার সহচর। অন্যদিকে চুড়াদের ছেলে ধনিরাম, সে যেন অনেকাংশেই জীবনমুখী। গান তার আশ্রয়, তার সম্বলহীন জীবনের একমাত্র সম্বল, তার ভাবনাচোখের আলোভালো, মুক্তমালা।গ্রামীন অন্ধত্ব ও কুসংস্কারকে সে প্রশ্রয় দেয় না। গ্রামের বুড়োরা তাকে সহ্য করতে পারে না। মানুষের আসা, যাওয়া, মান, অহংকার, সুমতি, কুমতি, ক্রোধ, দয়া, ভাগ্য, ঈশ্বর তাঁর গানের বিষয়বস্তু। সে মানুষের শুভবুদ্ধি জাগাতে চায় তার গানের মধ্য দিয়ে। উপন্যাসের প্রায় প্রথম থেকেই তার উপস্থিতি।  

আরেক চরিত্র উধম সিং-এর বড় ছেলে বংশীলাল। সে লোভে প’ড়ে যায়। আনন্দ, ফুর্তি, নেশার রঙীন স্বপ্নে সে সুখলালজীর মতো ধূর্ত লোকের দালালে পরিণত হয়। গ্রাম থেকে লোক ধ’রে আনা তার কাজ। কিন্তু সে পরবর্তী কালে সেই ফাঁদ টের পায় ও বিদ্রোহ করে। গঙ্গারাম যখন তাকে বলে মালিক তাকে নোকরি থেকে লাথ মেরে তাড়াবে, সে তখন উত্তর দেয় ‘ভালোই তো, সবাই গ্রামে ফিরে যাবে’। কুন্তির মৃত্যুর পর সে যখন ষড়যন্ত্রের শিকার হয় তখন সে সুখলালজীকে আক্রমণ করে লোহার রড নিয়ে, ও তার পরিণতি হাজতবাস।

চৌধুরী সুখলালজী, লালা গোবিনজী লোভ, ক্ষমতার, নিষ্ঠুরতার জ্বলজ্বলে চিকচিকে প্রতিভূ। একটাই লক্ষ্য মানুষ ঠকিয়ে পয়সার গদি। একটাই ইচ্ছে মানুষের অসহায়তা ও দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করা। জায়গা, জমি আত্মসাৎ ক’রে অর্থ উপার্জন। “লালা গোবিনজীর হাতের পাঁচ আঙুলে নানান বর্ণের পাথর বসানো সোনার আংটি ঝিলিক খায়”। বেনিয়াবৃত্তির কালোছায়া।

আর এই সব চরিত্রগুলোই আবর্তিত হচ্ছে একটা জায়গা দখলকে লক্ষ ক’রে আর তা হচ্ছে চুড়াচামাড়দের বসতি, তাদের আশ্রয়।উপন্যাস জুড়ে যাদব, জাঠ ও গুজারদের ক্ষমতার প্রতযোগিতা, কোন্দল, পারস্পরিক বদনাম।বসতি উচ্ছেদ ক’রে মঞ্জিল বানানো, গ্রামের গরীব মানুষদের বহুতল বানানোর জন্য কুলি, মজুরের কাজে কম পয়সায় খাটানো।

এছাড়াও আরো কিছু স্বল্প-অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ চরিত্র রয়েছে। রামলখন, নাথুরাম, ঘনশ্যাম, ঈশ্বর বাল্মীকির বড়মেয়ে, সিদ্ধা যোগিনী, নাজিরজী, মুন্সিজি, রাও রাজেন্দরজী, রাজা উদিত শংকর সিং, গঙ্গারাম, পহেরাদার, বেশ্যাপাড়ার তায়াজী, কিষণকাকা, লাদু ফুপি, চন্দরভান, উধম সিং, লখনকাকার মেয়ে, টংকারাম,বালু সিং, উল্কিওয়ালা, কাশীরাম, দিলদার সিং, মনিবের পহেরাদার, ফুল সিং, রামজীবন সর্দার, ধোবিবউ খাজানী, ছুতোরমিস্ত্রির ছেলে নন্দকিশোর, হাবিলদার বচন সিং, রামধানি, ঠাকুর দয়ালহরি এছাড়াও গ্রামের বুড়োবুড়ি, যুবকযুবতী, শিশুরা…     

ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা এই উপন্যাসের বাস্তবতার সাথে জড়িয়ে আছে। চরম বাস্তবতার সাথে এই উপাদানগুলো এমনভাবে মিশে যায় বা বলা যায় মেশানো হয় যাতে পড়তে পড়তে হঠাৎ চমকে যেতে হয়। Franz Roh প্রথম এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। Alejo Carpentier-এর সংজ্ঞা দেন। Pedro Paramo এক অসাধারণ উদাহরণ যেখানে Juan Rulfo ভিন্ন সময়ফ্রেমের মধ্যে Juan Preciado-কে নিয়ে ফেলেছেন… গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও যিনি স্বপ্নকে ফেরিওয়ালা দ্যান, তাঁর লেখাতেও এই ম্যাজিক রিয়ালিজম অসামান্য রূপে উপস্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্র গুহ দীপঙ্কর দত্তের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন “আমাদের আদি সাহিত্য রচিত হয়েছে বাস্তব ও কল্পনা মিশিয়ে। রজ্জু যেমন সত্য রজ্জুভ্রমে সর্পও সত্য…। বিভ্রমের জগৎ, ফ্যানটাসি, আনরিয়াল রিয়াল, ভয়ভ্রম ইত্যাদি ম্যাজিক রিয়ালিজমের অন্তর্ভুক্ত” ভূমিপুত্রের মানসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে ঠিক তেমনই ‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’-এ রচিত হয়েছে জাদুবাস্তবতা। দুধা সিং-এর কথায় “মধ্যরাতে আগুনের গোলা হাতে নিয়ে যখন পাহাড় থেকে দত্যি-দানব নামত, তাদের সঙ্গে লড়ত (দাদা-পরদাদার কথা বলতে গিয়ে)” আবার একজায়গায় “রক্তরাঙা লাল চাঁদ আড়াল ক’রে একটি বিশাল পাখি উড়ে এল। আঁধার হয়ে গেল সবদিক। শক্তিশালী পুরুষেরা তির ছুঁড়ল, নানাবিধ অস্ত্র ছুঁড়ল, পাখির পালক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, রক্তের ফোয়ারা ছুটল। বন্যার জলে যেমন ডুবে যায় প্রান্তর, রক্তে ভেসে গেল সবদিক। সেই থেকে জলকষ্ট।” আবার কখনো তাউ দুধা সিং রাজ্যের সমস্ত ভ্রম চোখে নিয়ে একটি ছায়াকে যেভাবে দ্যাখে সেখানেও যেন জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া। 

যৌনলিপ্সা এই উপন্যাসের আরও একট অংশ। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এর প্রকাশ। কোথাও অবদমিত, কোথাও প্রকট।কোথাও কামোদ্দীপক, কোথাও সাড়াপ্রদানে উজ্জ্বল। কোথাও আবার পাশবিকতা থেকেই স্তন কেটে নেওয়া, কোথাও যোনিপথে রড ঢুকিয়ে দেওয়া। চিন্তা, কল্পনা, আচরণ, প্রথা, ভোগ, ও ভাগে শেষ পর্যন্ত যৌনতা, যা কখনো প্রভাবিত, কখনো প্ররোচক।রাধাজী ও বজ্রভূষণের দৃশ্য, দুধা সিং এর চরিত্রের যৌনবিকার (নবীনা মহিষের থলোস্তনে ঝাঁকুনি লাগলেও সে পুলকিত আবার নাতনীর দেহগড়ন দেখেও বিমোহিত), গঙ্গারামের হিংস্রতার মুখে কুন্তি, সরযূবাঈ-এর যোনিদ্বার চেপে এক মহিলার বসা, নারীদের সঙ্গী ক’রে মদ্যপানের ফুর্তি, রোহিনীর উপর সুখলালজীর নোংরা দৃষ্টি, মন্নুর কল্পনা, লাজবন্তীর চাহিদা, রাধাজীর ক্ষোভ, কৌশল্যা ও দিগ্বিজয়ের দহন শেষে বৃষ্টিসিক্ত রাত্রিবাস, রাধাজীর মহিষের স্তনের বোঁটায় হাত রেখে উত্তেজিত হওয়া, আবার তারই মধ্যে রুখাশুখা জীবনে গ্রামের মহিলারা গল্প করার সময় একে অন্যের ব্লাউজ ধ’রে টানে,  গা উদলা ক’রে দেওয়া, “’কা খজানা দেখন্ অরে’ বলতে বলতে বুকে মুখ নামিয়ে আনে। তাজাতরমুজের মতো বিশাল স্তনদ্বয়ের মধ্যে ছোট্টমুখ ডুবে যায়, সুস্বর লহরী তুলে দেহ দোলায় উভয় রমনী”। কোথাও যেন খেলার ছলেই সমকাম চলতে থাকে।না কোনো ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের আলোচনায় যবো না। কারণ কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্বে জীবনের এত ঘেরকে ঘেরা যায় না। 

এক ভিন্ন আবহ। অথচ এই দেশেই। আমাদের মরুভূমি কতটা? মনের মরুভূমি? না ভৌগোলিক? এভাবেই ভাবতে ভাবতে চিনে ফেলি এক অংশের মানুষের শারীরিক, মানসিক আকার, গঠন, তাদের লোভ, লালশা, হিংসা, পোশাক, চলন, বলন, প্রেম, ক্ষোভ, পুরুষ ও নারীর ভেদাভেদ, সামাজিক অবস্থান, হুহু, হিহি, লাম্পট্য, লিঙ্গোত্থান, লিঙ্গটান, নাঙ্গাদিন, জঙ্ঘাদেশ, দণ্ডমুখ, যোনিপথ, দুধভার, নিঃস্ব জল, আলো, আঁধারের ধুকপুকানি, হরিয়ানভি যাদব, জাঠ, গুজার, চুড়াচামাড়দের কোন্দল, অনাচার, যাপন, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, ক্ষমতার ঘিনোনেপন… আহা! চিনে নিই আমার এই দেশেই রচিত এই আরেক জগতকে। আরাবল্লী তার সাক্ষী হয়ে থাকে। দিনের পর দিন অত্যাচারিত, পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ(চুড়াচামাড়েরা) বোধ করে নিজেদের অস্তিত্ব। জাগিয়ে তুলতে চায়। যাদব, জাঠ, গুজারদের নোংরা কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের হারানো জমি নিজেরাই দখল করতে চায়। বেঁচে থাকার ও সামান্য উপার্জনের প্রলোভনে আয়ানগড়ের অসুস্থ পরিবেশে প্রতিদিন একটু একটু ক’রে শরীর, মন ও সর্বোপরি সম্মান খোয়ানো দলিত নিপীড়িত মানুষগুলো নিজেদের সম্মান ও জীবনটুকু টিকিয়ে রাখার আশায় ফিরে আসে গ্রামে। তাদের টিপছাপের নামে সেই লুট হয়ে যাওয়া ‘ঘাঁটি বস্তিতে’।তারা আর ঠকতে চায় না।তারা আর মরতে চায় না। দিগ্বিজয়ের নেতৃত্বে তাদের মধ্যে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বলা যায় মানুষগুলো নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। Jean Paul Sartre-এর সেই বিখ্যাত কথা মনে পড়ছে “Everything has been figured out except how to live.” আমি এক গদ্যে লিখেছিলাম— আসা-যাওয়ার মাঝের অংশই একজন মানুষকে মানুষ ক’রে তোলে। এভাবেই পড়তে পড়তে আলো জ্বলে, নেবে, শেষ পর্যন্ত আবার জ্বলে। কোনো কোনো চরিত্রে বহুরৈখিকতার বীজ বুনতে বুনতে এগিয়ে চলে কলম।

আমি কোনো বই নিয়ে লেখার সময় বাইরের অনুষঙ্গ খুব একটা নিয়ে আসি না। অবশ্য সে জ্ঞানে আমি অজ্ঞান। আমি লেখা থেকেই লেখার আলো টেনে বার করি। এক্ষেত্রেও সেই চেষ্টাই করেছি। 

“সে কুন্তি, যেন সৈকতে স্বচ্ছন্দ বসন্তের পাখি, সাহসে, সাধে সৌন্দর্যে, বনের হরিণী, ঘাসের বিছানায় আকাশ-ময়ূরী”  

“হৃদয়ের গভীরে তাদের অগাধ হৃদয়”

এই উপন্যাসের এই দুটো লাইন কেন জানি না তুলে আনলাম। পাঠক কিছু রিলেট করতে পারছেন কি?

সেই বিখ্যাত লাইন দিয়ে শেষ করি ‘The reasonable man adapts himself to the world: the unreasonable man persists in trying to adapt the world to himself. Therefore all progress depends on the unreasonable man’ তাকিয়ে আছেন জর্জ! এখানেই যেন দিগ্বিজয়ের জয়। যে মেনে নেয়নি। বদলে দিতে চেয়েছে তার জগতকে তার নিজের মতো ক’রে। একই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। তার লড়াই, তার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। বারুদের গন্ধ নয়, বারুদ জ্বললো সেখানে। আর শেষ পর্যন্ত কোনো পাখিই খামোশ থাকে নি, বন্ধন কেটে উড়াল দিয়েছে মুক্ত পথে…

লেখক পরিচিতি:

সব্যসাচী হাজরা, কবি ও গদ্যকার, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। 

ই-মেইল— debota123@gmail.com

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *