জীবন্ত ক’রে তোলার হর্ষোল্লাস

স ব্য সা চী  হা জ রা

— রবীন্দ্রদা কেমন আছেন?

— আছি, বিপন্ন সময়ে মানুষ যেমন থাকে।

— এই সময় নিয়ে কিছু লিখছেন?

— সময়ের সংকট জারিত হতেও সময় লাগে, মানুষের ভেতরের মানুষকে স্পর্শ করতে চাই তো।

— হ্যাঁ সে তো জ্বালাপ্রাপ্ত, আগুনের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া ছাই, দগ্ধ, দুগ্ধ উথলে ওঠা এক অস্বাভাবিক খোঁজ, স্বাভাবিক কোনাগমনে…

— হ্যাঁ তুমি ঠিক ধরেছিলে ‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’-এ

— এই ধরা ও আপনার এই বিশেষ ধারা আমি আপনার কবিতাতেও পাই।

— অবিকৃত এক কোপ।

— সে তো বিকৃতির মধ্যে থেকেই পৃথিবীরূপ বিকারের মধ্যে চাপ, তাপ, অনুঘটকের উপস্থিতিতে এক কাউন্টডাউন, শব্দের মধ্যেই আপনার যাবতীয় অস্তিত্বের রসায়ন/দ্রুত কখনোবা স্বতস্ফূর্ত দহন/বিষ্ফোরণ।

— ধুলো মাখতে চেয়েছি যে, অতল জানি তবুও ডুবুরির নেশাটুকু আছে যে

— ওই তো আপনার লাইটহাউস…

— গর্কি?

‘আজ খুব বরাত ভাল-চাল পেয়েছি’ ধীরে ধীরে কথাটা মিলিয়ে যায়…

কমলকুমারের মুখ আলোআঁধারি।

খাওয়া!

ভাত, যৌনতা, জগত হামা দিচ্ছে ত তা ত… রাত বাড়ে তাত বাড়ে

তোলপাড়। সমাজ, সংস্কার, প্রথা, আধিপত্য, কাঠামো ভাঙতে ভাঙতে এক মুক্ত উচ্চারণ। আত্মবিশ্বাস। শব্দশক্তি। ভেঙে পড়া সীমারেখা। ফলামুখে জীবনের লাফ। ‘অশ্লীলতা’ নিয়ে একঘেয়ে প্রশ্নের মুখে সজোর পদাঘাত। বদলে দেওয়াই বদলের একমাত্র হদিস। বুকের নিচে, বুকের উপরে নিরন্তর শব্দঘূর্ণি। জীবন্ত ক’রে তোলার হর্ষোল্লাস।

 

‘রবিন বাবুর ঘড়ি’ চলমান…

রক্ত দিচ্ছে বারীন

কে যেন একবারই দম দিয়েছিলো

রূপান্তর চলছেই

বিলাসিতা কখনোই নয়

‘স্থ’ ভেঙে স্বতঃ

বিশ্বাস নিঃশ্বাস নিম নিম নিম

‘দিল্লি হাটার্স’ ‘দিল্লি হাটার্স’ ‘দিল্লি হাটার্স’

 

— রবীন্দ্রদা আপনার অবস্থান?

— কোথাও দাঁড়িয়ে নেই।

— এই যে আপনার না দাঁড়ানো, আরেকটু সরাসরি বললে সচল থাকা, আপনি বলেন ফকিরি জীবন, ফকির কেন?      

— সঞ্চয়ের জন্য।

— কোন সঞ্চয়?

— একজন ভিক্ষুকের যা হয়, জীবনকে দ্যাখার অভিজ্ঞতা। সরাসরি যাকে বলি অন্দরে ঢুকে পড়া।

— সত্য যদিও রিলেটিভ।

— হ্যাঁ তা বটেই, দ্যখার চোখ, শোনার কান, স্পর্শের অনুভূতি, এসব তো বদলাবেই।

 সেই মানুষ লেখায় সাবধানী নন, নিজের অস্থিরতা সঞ্চারিত করেন পাঠকের মধ্যে, একই সঙ্গে ফেটে পড়েন ভেতরের তারাজন্ম ও তারামৃত্যুতে। ছকের বিপরীতে নিজস্ব পরিকল্পিত এক আঙ্গিকে তাঁর যাত্রা। নির্মাণের জন্য ত্বরণ মাপতে মাপতে তিনি বাস্তবের কার্ভগুলো দেখিয়ে দ্যান যা ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশে সম্ভব। দেখিয়ে দ্যান স্বাধীন ও পরাধীন অথচ চলক-অস্তিত্বের ভেদ ও অভেদের কামনা বাসনাতাড়িত মানুষের ভুঁ ভুঁ ধ্বনি। আড়াল তুলে ভেতরের মলমূত্র মাখা মুখ যেমন দ্যাখান তেমনই ‘ঝলমলে মুখের কীর্তিখেলা’। যৌবনের ঝড়/ তড়িৎনালী/ বালিময় নগ্ন শরীর/ জল-জঙ্গলের বন্যবুক/ সমুদ্রফেনিল লালাময় বুদ্বুদ/ পাওয়া, না পাওয়ার মাঝে নিরন্তর সাঁ সাঁ শব্দ/ জন্ম-মৃত্যুর মাঝে জীবনের আহরণ/ রক্তক্ষরণ ও তঞ্চন। ক্লোজ-আপ, ক্লোজ-আপ, ক্লোজ-আপ, ছেতরে ওঠে কাঠামো, খুলে পড়ে বুকের হাট-পাট, ভর, ভার, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বদলে যায়, বদলে যায় চলার মানচিত্র।

‘বগলছোঁয়া কাঁধজোড়া ব্রেসিয়ার, আর/ নিরীহ দুধহীন আভাসিত ঠোঁট—/ একঘেয়ে বিষাদেরও রকমফের আছে নির্ভুল ত্বকের ছোঁয়ায়/ ইতস্তত যতই কথা হোক নীরবতার সেতু সরে না, মঞ্চ থেকে নেমে/ কিংবদন্তীর মানুষ যৌবনের ঝরনা খোঁজে— শ্রেফ দুঃস্বপ্ন,/ খেয়ালখুশি মতো যারা দেশান্তরী অথবা নিখোঁজ চুপ্পিসাড়ে হাত নাড়ে/ পূর্বতন স্ত্রীর সাথে খেলতে চায় বুড়ো বয়সের খেলা শ্বাসশব্দহীন…’

(নীরবতার সেতু)

দরজা খোলা?  ঢুকে পড়ো

অথবা খড়খড়ি তোলো উঁকি দাও, দাও, দাও… আরে লজ্জা কিসের?

অথবা শক্তি থাকলে ভেঙে ফ্যালো দরজা/ জানলা/ দেওয়াল

ভাঙামানুষ গড়ামানুষ অথবা মানুষের ভাঙা-গড়াগুলো

 

রবীন্দ্র গুহ ও তাঁর accelerator

Or,

রবীন্দ্রদা ও তাঁর superconductivity cyclotron

সংকরায়ন জীববিজ্ঞান থেকে শুরু ক’রে, রসায়নের অরবিটালে যদি হয়, খাদ্যাভ্যাসে, পোশাকে, ভাবনায় ও নির্মাণশিল্পে যদি বাসা বাঁধে, তাহলে শব্দে নয় কেন?

— যে বাঙালী ছেলেটা হাইওয়ের কোনো পেট্রোল পাম্পে চাকরি করে এবং সে যদি লেখক হয়, তার কথা যদি ধরো, দিনের শেষে তার লেখায় সুললিত শুদ্ধ বাংলাই কি আমরা পাবো? ভাবো তো একবার।

ভাবতে বসি। যাপন + পর্যবেক্ষণ + শণাক্তকরণ + সংকরায়ন + অধঃক্ষেপন + স্থাপন। এর এই ফাঁকগুলোর মধ্যেই আছে অনুভূতির নগ্ন ফ্ল্যাশ, অবিরাম গতি। জীবনের সামগ্রিকতায়, ভাষায়, উচ্চারণে, বহুরৈখিক বহুকৌণিক পরোয়াহীন এক ঝোঁক। ইন্টারলকিং ও আউটারকলিং এভাবেই জুড়ে যায়, এই ঘর্ষণ তাই কি বারবার রীতির বিপরীত রীতির কথা বলে। ডিস্টার্বড কার্ভ তাই তো ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। চিন্তা-ভাবনার কেওটিক ঘূর্ণাবর্ত। জন্মের আগের ঘামপূর্ণ যন্ত্রণা, আর্তি, আক্রোশ, আয়াস, হুহু, হাহা, হেঁচকি, রক্তজল চোখ। শ্মশান সেই আগুনই দেখায়।

‘আত্মার ক্ষুধা, আঃ, কুঞ্চিত বনমানুষের থাবা, গলে যায় পাকস্থলী/ কী শীতল শোক, উদর তক্ মর্মান্তিক মাতালের দুঃখ ছোঁচামু/ শুনছেন কি বলছি? ধন্যবাদ দেবেন না?’ স্ফটিকতুল্য বটফল,

অদ্ভূত অনুভূতি গায়ে লাগছে হাওয়া। যাঃ যাঃ’ বলে তাড়াতে পারিনা।/ মধ্যরাতে ছুঁতে গিয়ে ডানকাধে জড়ুল দেখলাম, স্বপ্নে বিভোর টু-শব্দটি/ নেই। ত্বক কাঁপছিল থিরথির করে। আহ্লাদিনী, তোমার বিজ্ঞাপন/ দেখলুম মার্বেল মূর্তির গায়ে-তার নিচে লেখা ‘বৃদ্ধ ধৈর্য হারিও না’—

পাখিরা উড়ে যেতে যেতে শব্দ ছড়াল— ‘খুন জ্বলনশীলার বুকে যৌনরাক্ষুসী/ অতিরিক্ত ছায়ার অস্থিরতায়।’ (দৈবাৎ শ্মশানের পথে)

— পড়তে পড়তে মেলাচ্ছি বাস্তব ও তার আগে লাগানো ‘অ’। যা আরও বাস্তবের গভীরতাকে প্রাঞ্জল করছে এবং ইঙ্গিত করছে সেই ভবিষ্যতের যেখানে সাদা/কালোর বাইরে রচিত হবে ধূসরের ভিন্ন ভিন্ন শেড, অধুনান্তিক শব্দকেও টপকে যাবো? ভাবনার পিঠে মুখ লাগিয়ে লালায় ভেজানো মুখ দিয়ে ওই পিঠের মুখ দেখতে চাই। হড়কে যায়। এখানেই বোধ হয় রবীন্দ্র গুহ রহস্য তৈরি করেন, প্রশ্ন ওঠে ‘তুমি সুখী নও?’

Rubens-এর The rape of the Daughters of Leucippus , Maurice Denis-এর ‘Psyche’, Gustav Klimt-এর ‘The kiss’, Edgar degas-এর ‘After the bath’,  Henri Matisse-এর ‘Nude’, Othon Friesz-এর ‘Temptation’, Picasso-র ‘Nude youth’, এভাবেই চলতে চলতে Darwin Leon-এর ছবি, কোনো ঐতিহাসিক দিক অথবা কোনো ইজমের জটিলতায় নয়…  দেখছিলাম বুকের কখনো সামগ্রিক শরীরের আলো/ অন্ধকার।

— দেহের নগ্নতাকে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম তার মতো ক’রে ব্যবহার করেছে, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র…  কামসূত্র কি অশ্লীল? দৈনিক যৌনক্ষুধা জীবনের সাথেই মাখামাখি ক’রে আছে।

— ঠিক তাই ‘শরীর থেকে শরীর লুট হয়ে গেল’। ইচ্ছায় কখনো, কখনো বলপূর্বক।

‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’ নিয়ে লেখার সময় তুলে এনেছিলাম গোটা উপন্যাস থেকে—

‘থলোস্তন’, ‘দেহের সমস্ত গড়নশোভা যেন বুকে কেন্দ্রায়িত। যা আঁটপিঠে কামিজে আঁটেনা’, ‘উবড়ানো স্তন’, ‘উথলানো বড় বড় গোলস্তন, ‘স্ফীত-স্তন’, ‘তাজা তরমুজের বিশাল স্তনদ্বয়’, ‘হরিৎবর্ণ বেলস্তন, নিটোল পদ্মের মতো, বৃন্ত বিচ্ছুরিত’, ‘বুকের অনেকটা অংশ বেলুনের মতো উবলানো, মসৃণ দুধে-আলতা রং’, ‘মোটা স্তনের বোঁটা, উষ্ণ রগছোঁয়া’, ‘উবলানো স্তন-বাঁধুনি’, ‘দুর্বৃত্ত বুকের দুলুনি’, ‘মোটা-খাড়া স্তন’, ‘হাটপাট খোলা মুক্ত ঊর্দ্ধাঙ্গ’, ‘সুডৌল স্তন’, ‘উবড়ানো বুকের শোভা’, ‘থলথলে মস্ত দুটি স্তন’, ‘কাঁঠাল জামের মতো উদলা বুক’, ‘বিরাট স্তন’, ‘উবডানো স্তন’, ‘আব্রুহীন বুক’, ‘উভরে পড়া স্তন’, ‘বস্ত্রহীন বুক’, ‘বিরাট স্তন উঁচু করে ঠেলে তোলা’ এভাবেই একে একে উপন্যাস জুড়ে কখোনো মহিষানীর কখনো বা মেয়েদের বুকের গঠন দিয়ে সৌন্দর্য, পুরুষের লোভে, কামবোধে মেয়েদের স্তনরূপ কখনো বা শূন্যতা কখনো সব হারানোর যন্ত্রণায় স্তন বা স্তনুয়া বা দুদু যেন জীবনের মুখ হয়ে উঠেছে।

‘দিল্লি হাটার্স’-এ তাকাই এবার—

‘আঁশটে বীর্যগন্ধময় যোনি নাভিতল ভৌগোলিক বুক’

‘স্তনের আড়ালে যত্নে লুকোনো ছিল মুখ আর নেই’

‘বুকজোড়া গোলাকৃতি আগুন’

‘হাত রাখো যন্ত্রণার কুসুমস্তনে’

‘টোকা দিলেই জেগে ওঠে চুপসা স্তনবোঁটা’

‘পাতাফুল তোলা বিনোদিনীর আঁচলতলে বর্তুল চাঁদ’

‘ঝুনুরঝুনুর কাঁপে জোড়াবেল বুক’

‘বুকের উপর উবুজ্বলন্ত সূর্য লাট খেতে থাকে’

‘জলরঙে আঁকা স্তনচিত্র শোষণ চায়’

‘বুকের ভিতর দুর্গ চুরমার হয়, বুকের ভিতর নৈঃশব্দের প্রজাপতি’

‘শব্দের বুকে বুক রাখি না’

‘স্তন থাবড়াতে থাবড়াতে ঘুম এসে যায়’

‘ঘুরপাক খাওয়া প্রজাপতির বুক, বুকের ওপর শঙ্খস্তন’

‘বুকের ভিতর ইজারা নেয় দশমচাঁদ নিষিদ্ধ আহ্লাদ-বেলবাহার/ স্তনযুগল অন্যরকম কেন?’

‘তার স্তনিত বুক আর মুখখানা ঝলমল করছিল কীর্তিখেলায়’

‘আলস্যে গড়ায় ছড়ায় বহুল হাত-ফেরতা স্তনুয়ার লিফলেট—’

‘বজ্রপাতের দরুন দুলে উঠছিল স্তনকমল…’

‘খোলসখোয়া স্তন’

‘স্তনের আড়ালে যত্নে লুকোনো মুখ পাতাছাপ’

‘শাওয়ারের নিচে/হরিয়ানাভি নারী বৃত্তবাঁকে পা— আপন বুকের দিকে তাকাতে আতঙ্ক’

এরকম কত কত…

এভাবেই ঊরু, পাছা, লিঙ্গ… শরীর থেকে শরীরে তার নোঙর ফেলা। আবরণহীন ইচ্ছে, লালশা, ভোগ, বুকের মধ্যেই সে উত্তপ্ত শলাকা। যৌনতার হিল্লোল, কল্লোলিত ঘাম। ‘ধোঁয়া, ক্রোধ, দুর্গন্ধ, সঙ্গম’, ‘বিছানার নিয়ে দরকষাকষি’। বুকের মধ্যেই জন্ম ও মৃত্যুর নিরন্তর ধ্বনি। বুকের মধ্যেই বিশ্ব আঁকা, বুকের মধ্যে বিশ্বখুন। শ্মশান ও শূন্যতার হাসি। প্রসূতিসদন ও পূর্ণতার দুগ্ধপান। বয়ঃসন্ধির শারীরিক ও মানসিক উচ্চারণ। উন্মাদনা, ধুকপুক। ‘ভাঙাচোরা চুমু’। বারুদ ও অগ্নিসংযোগ।

কবি যেন রিপুতাড়িত মানুষের স্বরূপ উন্মোচনে আলো ফেললেন। 

দেহ থেকে দেহ, দেহ’র মধ্যে দেহ, উপরে, নিচে, পাশে… তার মধ্যেই প্রেম, বিকার, মৈথুন, ঘৃণা, অত্যাচার, চাপা দেওয়া ও উগরানো।

দিল্লির রাস্তায় চওড়া কাঁধ। কুড়িয়ে তুলছে উপাদান, শুঁকে বুঝছে বমি, ঝুঁকে দেখছে রক্তের দাগ, চেটে নিচ্ছে ধুলো ধুলো ধুলো… সময়ে ঢুকে পড়ছে সময়ের খিদে। আপনার দ্রোহ তাই দ্রুত হোক আমাদের সাথে। পা ফেলছে ছাপ, আবার মুছে দিচ্ছে পা। দূষণ, ক্লেদ, পুঁজ, বমি, থুতু, রক্ত, হাহাক্লান্ত শহরের নিচে আরেক শহর। মুখোশ ছিঁড়লে দগদগে ঘা। রাজনীতির সংকীর্ণ দালালি,  ক্ষমতার বেসাতি, দখলের ঘৃণ্য মানসিকতা, পুঁজিবাদের অহংকারেরর বিরুদ্ধে কবির অকপট উচ্চারণ— ‘দিল্লী, তুমি আর লাথিও না নিজের ধড়— ওপেন আপ ইয়োর ড্রিমস/ দাঁড়কাক রাজনেতাদের আমি সহ্য করতে পারিনা’। ডায়লগ মনোলগ ও গাণিতিক চেতনায় পুরাণ, ইতিহাস, সমসাময়িক চরিত্রে যেন ভেকধারী এক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে কবির নির্লজ্জ কলম, ধর্মীয় অন্ধ বিভাজনের বিরুদ্ধে কবির শানিত বিদ্রুপ। ঘুণসর্বস্ব রাজনীতি-অর্থনীতির জাঁতাকল। আপাত মহা-যা কিছু তার খোলস টেনে ধরা, ভেতরকে ঝাঁকিয়ে দেওয়া উন্মুক্ত এক জীবনদ্বন্দ্ব। বিশ্বাস  ও সম্পর্ক সর্বোপরি সময়ের মধ্যে কেওটিক এক ভৌগোলিক বিস্তার। সময়ের ধুলো,  বালি, কাঁকর,… সবই লেখায় হয়ে উঠেছে জ্যান্ত। গর্ভস্থ পদার্থের নির্গমন। জ্বালামুখ, জ্বালামুখ…

— চোর, খুনি, সাধু, বুভুক্ষু, দালাল, শহর থেকে শহরে সবাইকে দেখেছি যতটা কাছ থেকে…

— তাই কি এই ভাষা বদল?

— Absolutely, রাজস্থান, দিল্লি, ভূপাল, মুম্বাই, চন্ডিগড়, গুরগাঁও, চওড়া রাজপথ, গলি, তস্যগলি হেঁটেছি, ছুটেছি, unsettled এই আমি, শিল্পাঞ্চলের এই আমি, তাদের ভাষায়, তাদের সংস্কৃতিতে ডুব দিয়েছি।

— ডায়াস্পোরা!

— তাই তো সবাই বলে।

— এই সাহস আপনি প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলায় দেখালেন, আগে ঘটলেও এর ব্যাপক প্রয়াস আমাদের সামনে প্রকট। যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে যে স্পন্দন তাকে শরীর দিতে এ ভাষা অনিবার্য, আপনাকে স্যালুট।

 

‘জেসিকা লালের দিল্লীতে মানুষের অমানুষপনা নিয়ে কেউ কি বলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা?’

‘এই দিল্লী জাফরের কবিতার ভুবন, আর / গালিবের আজান-মন্দির—/ আজ খর বৈশাখ’

‘দিল্লীর যুবকরা শ্মশান পেরিয়ে ঝুলছেঁড়া জামা গায়ে হেঁটে যাচ্ছে জোছনাপাড়ার দিকে’

‘দিল্লী শহরের দখল নিয়েছে বাকচতুরেরা’

‘দিল্লী, তোমার ফুসফুসে পুরনো ছাইপাঁশ, কপালে মরা ইঁদুর, দিবালোকে নারী ধন্দে পড়ে তন্দুর হচ্ছে— দিল্লি, চাঁদনিচকে সেই জ্যোৎস্নালোকিত প্রাঙ্গণ কোথায়? পথ কুড়োনো পথ, স্বার্থের বাইরে জীবনের অংশ নিমতুল্য। নিমতুন রক্তমাখা চোখ’।

‘দিল্লী, তুমি কার? দুর্যোধনের? পাণ্ডবের? ইন্দ্রপ্রস্থের রূপকার শ্রীকৃষ্ণের? আকবর বাদশার? হুমায়ুনের? ‘কুতুবউদ্দিনের? নাদির শাহর? তোমাকে নিয়ে কত খেলা— দিল্লী থেকে দৌলতাবাদ, ফের দিল্লী, ফের দিল্লী থেকে আগ্রা, আগ্রা থেকে দিল্লী। তোমার বুকে জতুগৃহদাহ, ভ্রাতৃহত্যা, পিতৃবিদ্বেষ। জুমহা নামাজের দিন বাহাদুর শাহজাফরকে চ্যাংদোলা করে প্রাসাদের বাইরে আনা হয়েছিল। দিল্লী, ইহা কার অনুগ্রহে? অন্যকে বাচানো মানেই তো নিজে বেঁচে থাকা। দিল্লী, তুমি কি সত্যি সত্যিই বেঁচে আছো?’

 

আহা! এ প্রশ্ন যেন ভেতরকে তছনছ ক’রে দেয়। শহরের ইতিহাস থেকে জন্ম নিচ্ছে অলিখিত এক ইতিহাস।

না-সাহিত্য নিয়েই তাঁর চলা। লেখক হওয়ার থেকেও জীবনের অন্দরমহল লিখে ফেলাতেই সেই তাড়না টের পাই। টের পাই বহু চরিত্রের সংযোগে তাকে প্রাণ দেওয়া। কখনো মিথ ভেঙে পড়ে,  কখনো চরিত্র আছাড় খায় বাস্তবের শ্লেষ-এ। কে যেন বিদ্রুপ করে নিজেকেই। পুরান, মহাকাব্য, লোকাচার, স্থানিক সংস্কৃতি, ঢুকে পড়ে। অলৌকিক অনুষঙ্গ জায়গা ক’রে নেয়, মিশে যায়, বহুমাত্রিক আলো/অন্ধকারে। যেন এক মিশ্রণে এক ভিন্ন বাস্তব হোলো, পায়ে বিভ্রমের জুতো। রূপকথার বোতাম খোলা। কখনো ভ্রমস্বপ্ন।

‘সেবার বেড়াতে গিয়েছিলাম বনপাহাড়ীর দেশে, উনপাখিদের পিছে/ ছুটেছিল যে আলোকিনী, সে বলেছিল: তোমার বুক থেকে/ রক্ত ঝরছে না কেন? তুমি কেমন পুরুষ? ইউ দ্য ডেড-ম্যান!/ ভুল পথে সেবারই শেষ ভ্রমণ’

‘ঘরে ফিরছে পলাতক কবি নেশাগ্রস্ত। চোখে চশমা নেই/ হাতে শাদা শূন্য পাতা/ আজও ঈশ্বরের নামে সে থমকে দাঁড়ায়।/ দূরে সরে যায় শব্দ সাপলুডো খেলে— হবহু কবিতার মত/ উড়ে যায় শ্রীমতী অলৌকিক সাপ— ইশারায় পালক নাড়ে। মধ্যরাতের বৃষ্টিভেজা শহর কলকাতা।’

অর্জুন, দ্রৌপদী, শকুনি, যুধিষ্ঠির, আলেকজান্ডার, যিশু, জুডাস, কৃষ্ণ, হর্ষবর্ধন, বিনোদিনী, গান্ধারী, মাদ্রী, গহরজান, হকিং, নীরোদ সি চৌধু্রী, মিশেল ফুকো, অ্যালেন গীনসবার্গ ঢুকে পড়ছে চিত্রময় শব্দের ব্ল্যাঙ্ক স্পেসে, টাইম টাইম টাইম…

— সমাজ, অস্তিত্ব, টিকে থাকার যে যন্ত্রণা, ভ্রূণহত্যা, ধর্ষণ,…

— ওহ!

— এ যেন সভ্যতার মজ্জায়

— ঠিক, মুক্তি কই?

— এ তো সামগ্রিক মানবতার ধর্ষণ

— এই পৃথিবীর মানুষ, পৃথিবীর মানুষকেই দিয়েছে অনিশ্চয়তা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সম্মান, বেঁচে থাকার অধিকারেও সে পেন্ডুলাম, শুধু যতদিন দোলনকাল আছে, এই মুহূর্তের পৃথিবীকে দেখি, শুনি…

— Paul Bradley আপনার অভিজ্ঞতায় সেই Esther— 

‘I am one of the lucky ones. I was not raped’ কানে বাজছে…

‘জীবনের নামে হু-হু জীবন গন্দা হ্যাঁয় পর ধান্দা হ্যাঁয়/ স্মৃতি কল্পনা কামনা কি পাপবোধ? ধর্ষিতা, তোমার নাম কি?/ গীতা, সুনিতা, জুবিনা, সার্জিনা…/ ধর্ষিতা, তোমার বাড়ি কোথায়?/ হরিয়ানা, দিল্লী, মুম্বাই, কলকাতা…’

স্তব্ধ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ, আমি ও নিমসাহিত্যের পাকস্থলী রবীন্দ্র গুহ…


একটি কবিতা বই থেকে—

 

ইমলি পাতায় হাতির নাচন

 

বুকে ফুঁসছে চাঁদ দারুবনে দুধবেলুন ইপ্সিত পেশীতে বেড়াবেণী, স্বপ্নে দংশায়

মাতালগন্ধী ঝাঁক-ঝাঁক পোকা, ভাবুন কি বিপজ্জনক বয়স

বলিরেখা অত্যন্ত পরিশীলিত দেহবিলাসের রহস্য চক্ষু অব্দি নাভিতে তুরপুন

বুকে সপাং চাবুক, সবগাছ উন্মূল-গরমে বড় কষ্ট ফি-বছর

পাংগাবা ঊনযুবকেরা লেবেনচুষ জিভে তর্জনী নাড়ে— আত্মার কিস্তিমাৎ

স্বীকার করতেই হয় যতদূর যাই পিছনে বাজনদার-আত্মবিশ্বাসীর কোনো ধর্ম নেই

হৃদয়ভাঙা শিকড় ওপড়ানো

আমি এবং একা সে সামান্য সত্য

শূন্যতা কুড়োতে কুড়োতে বহতা জীবন হাতের মুঠোয় অথৈজল

হ্যাঁ, মেয়েটি দৌড়ে আসে কালো বেঁটে ভয়ানক উলঙ্গ আদি অন্ত নেই

বস্তুত শতছিদ্র স্মৃতি— যে যার মতিগতি নিয়ে থাক আমার অনুগত আত্মায়

বছরব্যাপী দুঃসময়—

বহু জটিলতার মধ্যে লম্বাপনা মুখখানি মনে পড়ে— উদোম ভূতেশ্বরী

দু-জন পুরুষ দু-টুকরো হয়ে এক হয়ে যায়-দুজন বহুকোষী স্ত্রীলোক

অনন্ত খোপে পা ফেলে ফেলে হাঁটেন সমাপ্তি শূন্যতায়

অনেক তো হল— প্রচুর ছল নৈতিক বিরোধিতা বৈরিতা, জীবন যেমন ছিল

ঠেলাধাক্কা খেয়ে তেমনি আছে— দিল্লীশহরের দখল নিয়েছে বাকচতুরেরা

প্রতিদিন অগণিত স্পিরিচ্যুয়াল ডেথ— উনসা শব্দ জাল বুনছে বুকে

একটিমাত্র প্রেমগীত ইমলিপাতায় হাতির নাচের মতন প্রতিদিন আকস্মিক।

লেখক পরিচিতি:

সব্যসাচী হাজরা, কবি ও গদ্যকার, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। 

ই-মেইল— debota123@gmail.com 

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *