রবীন্দ্র গুহ-র উপন্যাস ইহদিল্লি শহরনামা

স ঞ্জী ব  নি য়ো গী

প্রিয় প্রবুদ্ধ পাঠক,

সাধারণভাবে যে-কোনো প্রকার লেখার ব্যাপারেই আমার অনীহা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিশেষত প্রবন্ধ বা পাঠপ্রতিক্রিয়া। তাই এই লেখার জন্য কথা দেবার আগে মনে দ্বন্দ্ব আর দ্বিধা কাজ করছিল। কিন্তু কথা শেষ অবধি দিয়েই ফেলেছিলাম। না বলতে না পারার পেছনে হয়তো রবীন্দ্র গুহ নামটা কাজ করছিল। বহু বছর আগে এই লেখকের শিকঞ্জের পাখি খামোশ উপন্যাসটি নিয়ে দু-চার কথা লেখার সুযোগ ঘটেছিল অজিত রায় সম্পাদিত ধানবাদ থেকে প্রকাশিত শহর পত্রিকায়। সেই বই পড়ে আমি ‘স্পার্টাকাস’-এর কথা স্মরণ করেছিলাম। রবীন্দ্র গুহ তাঁর ‘কেন লিখি কীভাবে লিখি’ নিবন্ধে বলেছেন— 

“দেয়ালে ঠেস দিয়ে বিশ্বভ্রমণ আমার পছন্দ নয়। লেখালেখি আমার বিলাস নয়।… আমি কখনো কাল্পনিক খসড়া তৈরি করি না।” 

আরাবল্লি সন্নিহিত জীবনের অবাক, নিবিড় ‘দর্শক’ রবীন্দ্র গুহ, আমার বারবার এ-কথা মনে হয়েছে। আর রবীন্দ্রদার এই অহংকার সত্যিই মানায় যে, তিনি ঘরে বসে মোটেও কাল্পনিক ছক কষেননি কোনো একটা নিটোল লেখা লেখার। আর তাঁর উপন্যাসগুলোর দিকে তাকালে, দেখবেন কোথাও কৃত্রিম লুলুপুতু বর্ণনা বা ছকবাজির জাল নেই। বেশ গোছানো বিন্যাস মোটেও ধাতে সয় না এই লেখকের। রবীন্দ্রদার টেক্সট একটু মুখে নিয়ে জিভে নিয়ে স্বাদ নিয়ে দেখুন, বুঝবেন এখানে সফিস্টিকেটেড শিল্প ধারণার এক্কেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কাজ করা হয়েছে। জিভে একটা coarse স্বাদ পাবেন। একটা unfiltered পানিয়ের raw feeling যেন পাঠকের স্নায়ুতে বাসা বেঁধে বসে। আর সে বুঝতে পারে, বাংলা ভাষায় এই সৃজন আগে সে দেখেনি। 

আপনি জানেন, একজন পাঠক, যেহেতু সে অভিযাত্রী, তাঁর যদি জীবন-ব্যাপারে কোনো রিজিডিটি থাকে, তাহলে নিজে হাতে সে অভিযাত্রার মজাটা আগেই শেষ করে রাখে। পাঠকের নিজস্ব যাত্রা শেষে, সে শুধু এটুকু চিহ্নিত করতে পারে যে, নির্দিষ্ট লেখকের কাজ-বিষয়ক মূল্যায়নে কোন বিন্দুগুলোকে সে কীভাবে বসাবে। আমি রবীন্দ্রদার হয়তো সব লেখা পড়িনি, কিন্তু অনেক দিন থেকে পড়ছি। এই লেখকের ব্যাপারে আমি কিছু খুঁটিনাটি চিহ্নিত করেছি। সেটা আপনার সঙ্গে শেয়ার করছি। 

১। রবীন্দ্র গুহ যে-ভাষায় কথা বলেন, তা অনুনকরণীয় 

২। যে-সমাজ আর মানুষ তাদের রক্ত ঘাম মাটির সুবাস নিয়ে, আর সেই বাচন-ভঙ্গি নিয়ে লিপিবদ্ধ হয় রবীন্দ্র গুহর রচনায়, তা অন্যত্র অপ্রাপ্য

৩। এই লেখকের সান্দ্র্য বাক্য পরিণতির মায়াজালে আমি জড়িয়ে পড়তে ভালোবাসি

৪। একটা ভুবন, যা বাংলা ভাষার পাঠক একমাত্র এখানেই পান  

    পাঠক, রবীন্দ্রদার ইহ দিল্লি শহরনামা পড়লাম। দ্যাখেন, আমি আজকাল ভাবি কী জানেন, একজন লেখককে কত পড়ব, ধুর, আর পড়ব না। এটা এইজন্য নয় যে, সেই লেখক আমার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। বরং এই জন্য আমার এরকম অবস্থান যে, নির্দিষ্ট লেখকের রহস্য আমি জেনে ফেলেছি। রহস্যের দিক দিয়ে দেখলে, আমার ব্যক্তিগত পাঠক-জীবনে তাঁকে নিয়ে আর করার কিছুই নেই। আমি তো নতুন ‘গল্প’ জানতে পাঠক ‘সেজে’ বসে নেই। যা জানার আগ্রহ, তা, নতুন টেক্সট-এর ভুবন।

 যাইহোক। বইটা পড়লাম। ‘…শহরনামা’, এই ‘…নামা’ শব্দটি ইঙ্গিত করে সেই জাতীয় বর্ণনার, যেখানে প্রচুর ইনফরমেশন ঢুকে গিয়ে তথ্যের ভারে তত্ত্ব চাপা পড়ে যাবার প্রচুর অবকাশ থেকে যায়। আর আমাদের মাথা তো এই অভ্যাসের দাস হয়ে গেছে যে, ফিকশন হবে তথ্যের গুরুভার মুক্ত। বা, তথ্য যেন আখ্যান জুড়ে কোথাও মাথাচাড়া দিতে না পারে। এই রচনাবিন্যাসে কিন্তু তথ্যভার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা লেখকের অভিপ্রায় ছিল বলে মনেও হয় না। কেন-না রচনার নামকরণেই সে-কথা আমার কাছে সাফ হয়ে গেছে।

রবীন্দ্র গুহ ব্যক্তিজীবনে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বিশেষজ্ঞ। একটা জনজীবন কীভাবে শিল্পায়নের অর্থনীতিতে তার সামাজিক ভাষার রূপবদল ঘটায়, কেমন করে যুগপ্রাচীন এক জেনারেশনের মন্থর বেঁচে থাকায় ও বাঁচার উপকরণে তথাকথিত উন্নয়ন মুখাপেক্ষী নবীন প্রজন্মের কড়ানাড়া শুধু মূল্যবোধই নয়, ভূগোলের ইকোলজি বদলে দিতে থাকে, সেই অবশ্যম্ভাবী প্রাকৃতিক ধসের দর্শক এই লেখক। সবুজের মাঝে নির্মল নিঃশ্বাসের ভেতর চিমনির ধোঁয়া ঢুকে যেতে দেখেন তিনি। সেই ধোঁয়া নানা রূপে আচ্ছন্ন করে বদলে যাওয়া সামাজিক বন্ধনকে। এই বই থেকে একটু শোনা যাক: 

“আরাবল্লির মাথায় অত লোক কেন গো? সারি সারি ট্রাক, ক্রেন, ডাম্পার?”

“পাথর পাচার হচ্ছে। যাবে মানেশ্বর, সোহনা, ভিওয়ানি। গ্রেটার টাউনশিপ হচ্ছে। বিশ মঞ্জিল, ত্রিশ মঞ্জিল বাড়িঘর। শপিং মল, পাঁচতারা হোটেল। মেট্রোরেল যাবে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে। তখন দিল্লির জেল্লা খতম।”

বাংলা লেখার বিষয়বস্তু আর ভৌগোলিক ডায়াসপোরা যাদের রচনায় চেনা ছকের বাইরে যাবার সাহস পেয়েছে, রবীন্দ্র গুহ তাঁদের অন্যতম। এই লেখকের হরিয়ানভি, জাঠ, গুর্জর চরিত্ররা তাদের নিজস্ব সুগন্ধ নিয়ে ঘোরাফেরা করে। তারা নিছক বং-ভুবন-লালিত বাঙালি পাঠকের তোয়াক্কাও করে না। তারা অকৃত্রিম হয়ে উঠে আসে, যেমন উঠে এসেছে এই ইহ দিল্লি শহরনামা উপন্যাসে। আরাবল্লি সন্নিহিত অঞ্চলের জীবন আর বাঁচনভঙ্গি জীবন্ত হয়ে ওঠে অগণিত ও সুপ্রযুক্ত প্রাদেশিক/আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগে; যা এই লেখককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার অন্যতম উপায়। তিনি বর্ণিত জীবনের পানিয়ে সফ্‌ট তরল মেশান না, পাঠক।

           দ্যাখেন, রবীন্দ্র গুহদের মতো সাহিত্য ব্যক্তিত্বকে ঠিককরে বুঝতে হলে হঠাৎ একটা উপন্যাস নিয়ে বসলে হবে না। সত্তর দশকের ‘নিম সাহিত্য’ বিষয়ে স্বল্পবিস্তর অবগতি দরকার। অর্থাৎ, সূচনায় ‘নিম’-এর মতো শব্দ নিয়ে রবীন্দ্র গুহ আসছেন। জনগ্রাহ্যতার পাঁয়তাড়া ওখানেই ত্যক্ত। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শব্দটা আজকাল গালাগালের মতো শোনায় পাঠক, কিন্তু ধারার বাইরে হাঁটার শুধু সাহস আর ইচ্ছে থাকলেই হয় না, ক্ষমতা আর প্রতিভা থাকতে হয়। ক্রিয়েটিভিটি থাকতে হয় অনেক বেশি। আপনি দেখবেন, ‘পরীক্ষামূলক’ বলতে অনেক ছেঁদো সাহিত্যিক এমনকী অনেক পাঠকও মনে করেন শুধু যৌনতার ভিভিড বর্ণনা আর খিস্তি খেউড়। তাঁরা অনাস্বাদিতপূর্ব টেক্সট বা সমাজজীবনের বিষয় নিয়ে ‘পরীক্ষা’ করার মতো পুঁজি নিয়ে আসেননি। আমার তো তাই মনে হয়। কিন্তু রবীন্দ্র গুহদের মতো লেখকরা আছেন বলেই আমরা ধারা বহির্ভূত রচনার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হই না। ‘বিষয়বদলকরণ’ যে-লেখকের গোড়ার বাসনা। আগে তুমি গতের বাইরে বেরোন। তারপর কথা হবে!

 

ইহ দিল্লি শহরনামা উপন্যাসের বিন্যাসে ও এই লেখার গল্প-গ্রন্থন প্রকল্পে আমি উল্লেখযোগ্য কোনো অভিনবত্ব পাইনি। কেন-না অতীত আর বর্তমান একাকার করে চরিত্রদের নানা কালে ঘোরাফেরা করতে আমরা ইতিমধ্যে বহুবার বিশ্বসাহিত্যের বহু উপন্যাসে দেখতে অভ্যস্ত। এই দিক দিয়ে এই লেখার প্রকরণ আমাদের চেনা। এখানে লেখক মহাভারতের কাল থেকে মধ্যযুগ ছুঁয়ে অত্যাধুনিক কালকে অবলীলায় মিশিয়ে দিয়েছেন।  

আগেই বলেছি, এই লেখার ইনটেনশন এমন, যাতে তথ্যভার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু সেই ভার কখনো পীড়াদায়ক মনে হয়নি আমার। আমি জানতাম, আমি কী পড়তে চলেছি। এমন স্মৃতিমেদুর এই বইয়ের স্থায়ী সুর; এমন কান্না লুকিয়ে আছে উদ্ধত, আজগুবি, খুলেয়াম, ঝাঁ চকচকে, ধূলিমলিন বিচিত্র সব মানুষের আসা-যাওয়ায়, প্রাচীন পলেস্তারা খসা আর নবনির্মিত ইমারতের আনাচে-কানাচে, যে, সেই ঘোর সামাল দিতে গিয়ে পাঠক অনায়াসে বয়ে বেড়ান কয়েক শতক পুরাতন তথ্যভার। 

আর আপনি তো জানেনই পাঠক, কেমন অনভ্যস্ত গল্পের ভেতর গল্প খুঁজে পাই আমরা রবীন্দ্র গুহর লেখায়। যাপনের কেমন মেডেন পরিসরে তিনি কলম চালান। তাঁর চরিত্ররা শুধু এ-কারণে আমাদের অনাস্বাদিত মনে হয় না যে, তারা বঙ্গ পটভূমির বাইরের। বরং এ-কারণে আমরা আকর্ষিত হই যে, তাদের জীবন-মরণের অদেখা দিকটা যেরকম ডাইমেনশন থেকে লেখক দেখতে পান, তা শুধু তিনিই দেখাতে পারেন।

 এই বই আমার কাছে তার গল্পের প্রাধান্য নিয়ে হাজির হয় না। এক জনজীবনের সামগ্রিক ভাঙাগড়া নিয়ে ভাবায়। উন্নয়ন আর আধুনিকতাকে নিজের মতো করে বুঝতে চায় এই উপন্যাস। 

লেখক পরিচিতি:

সঞ্জীব নিয়োগী

সাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ

ই-মেইল: neonirman1966@gmail.com

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *