আসানসোলে রেলোপলিস: এক সন্ত্রস্ত ঘরকুনোর অসমাপ্ত আত্মকথন

শা ন্ত নু  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

এই প্রবন্ধটি লিখতে বসেছি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যখন অন্তত আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য আসানসোল শহরের ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে। একসময় যা ছিল ছোট একটি রেলওয়ে শহর, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যা হয়ে উঠেছিল এশিয়ার বৃহত্তম শিল্প কেন্দ্র, আগামী দু-এক বছরে সেই আসানসোল এক রেলোপলিসে রূপান্তরিত হবে। কিন্তু এই রেলোপলিস জিনিসটা আসলে কী?

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত এবং ততোধিক বিতর্কিত নগর পরিকল্পনাবিদ সান্তিয়াগো ক্যালাট্রাভা মনে করেন, একটি রেলওয়ে স্টেশন সম্পূর্ণ একটি মহানগর তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দানবীয় প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে তিনি এই ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ছদ্মকৌশলে ক্যালাট্রাভার সিদ্ধান্ত নিজের পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করছে। গান্ধীনগরে যে-অতিকায় রেলোপলিস নির্মিত হয়েছে তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই সর্বভারতীয় পরিকল্পনাটি একমাত্র রিয়েল এস্টেট এবং খুচরো ব্যবসায় আগ্রহী বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ মাথায় রেখেই গৃহীত হয়েছে।

ধরা যাক ২০২৪ সালের মধ্যে আসানসোলে রেলোপলিস হবেই। তাই তো রেলের অব্যবহৃত জমি, বাড়িঘর সমস্ত কিছু মোটা অঙ্কের বিনিময়ে পঞ্চাশ বছরের জন্য লিজে দেওয়া হচ্ছে। একাধিক রেলের স্কুল বন্ধ করা হচ্ছে একেবারে অসংগত কারণে। ছোট দোকানদার এবং হকারদের ইতিমধ্যেই রেলের জমি থেকে কোনরকম কমপেনসেসন ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের মাঝখানে কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত রিয়েল এস্টেটের থাবা বসেছে একটা বড়ো শপিং মল এবং হোটেল নির্মাণের মাধ্যমে। তবে এসব তো শুধু হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

রেলোপলিস সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত করতে খুব তাড়াতাড়ি বর্তমান রেলওয়ে টাউনশিপের মধ্যে সবুজ ও খোলা জায়গাগুলি, যা আসলে এই শহরের ফুসফুস, তা পুরোপুরি দখল করা হবে। তাতে এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হবে। আর সর্বোপরি, কয়েক বছরের মধ্যেই এখানকার মোটামুটি তিন শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা একেবারে বদলে যাবে।

এমনই এক জটিল পরিস্থিতিতে এই প্রবন্ধটি আসানসোলের অতীতের দিকে কিছুটা ফিরে তাকানোর চেষ্টা করবে এবং ভবিষ্যতে আমরা কী হারাতে বসেছি সে-সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেওয়ারও প্রয়াস করবে।

 

আসানসোলে রাজবালা 

সেই দিনটা ছিল ২০১৯ সালের ৬ জুলাই। আমি নিজে এবং আসানসোল হেরিটেজ রিসার্চ গ্রুপের অন্যান্য সহকর্মীরা, সবাই মিলে পাগলের মতো ঔপনিবেশিক আসানসোলের রেলওয়ে সংক্রান্ত নানা গল্প খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। অনেকগুলো গল্প খুঁজেও পেয়েছিলাম। আর সেইসব গল্পের প্রায় প্রত্যেকটিই তৎকালীন ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার পি কে মিশ্র মশাই-এর হেফাজতে রেখে এসেছিলাম। তবে সেই ফাঁকে যে-কয়েকটা গল্প আমরা ভবিষ্যতের জন্য আলাদা করে সংরক্ষণ করেছি, তারই একটা প্রথমে তুলে ধরব। এক গরিব ঘরের মেয়ে রাজবালা বোস্টমির জীবনের গল্প এটা।

আসলে শুধুমাত্র কিছু গৌরবগাথাই যে আমাদের ঐতিহ্যের ধারণাকে নির্মাণ করে তা তো নয়। আর কেই বা বলতে পারে, এই সাধারণ মেয়েটির কথাই হয়তো আসানসোলের ঔপনিবেশিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাথাগুলির মধ্যে একটি। বিশেষভাবে সংগ্রামের, প্রতিরোধের, ন্যায় বিচারের কথা ধরা আছে এই গল্পে। এর প্রকৃত শক্তি, ঐতিহ্যের নিরিখে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে, আমাদের ছকে বাঁধা চিন্তাভাবনার পরামিতি কিছুটা পরিবর্তন করে নিতেই হবে।

৮ মে ১৮৯৫ তারিখে ৫-আপ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে, সন্ধ্যা ৭টায় আসানসোল স্টেশনে এসে পৌঁছায় মেয়েটি। দীননাথ রায়ের “আসানসোল আউটরেজ কেস”-এর ষাট পাতা জোড়া বিশদ প্রতিবেদন থেকে সেই গল্প সংগ্রহ করে দিয়েছেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের গবেষক শিল্পী দাস, সম্পূর্ণ নিজের উৎসাহে।

আগেই বলেছি— মেয়েটির নাম রাজবালা। তার বয়স তখন প্রায় ১৪ বছর। কিছু কুলি নিয়োগকারী তাকে স্বামীর বাড়ি থেকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে এসে, প্রথমে গোয়ালন্দ এবং তারপর আসামের চা বাগানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু গোয়ালন্দে পৌঁছানোর পর রাজবালা নিজের মত পরিবর্তন করে। তখন বাড়ি ফেরার জন্য সামান্য কিছু টাকা তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। রেলগাড়ি চেপে সে বর্ধমানে ফিরে আসে এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটে খানা জংশনে পৌঁছায়। তারপর জামতাড়ায়, যেখানে তার বাবা-মা থাকতেন, সেখানে ফিরে আসবার জন্য সে অন্য এক ট্রেনে চড়ে বসে। সঙ্গে তার কোনো টিকিট ছিল না হয়তো, কিংবা হয়তো সে টিকিট হারিয়ে ফেলেছিল রেলগাড়িতেই। তা যাই হোক, ট্রেনটি আসানসোলে থামলে, টিকিট চেকার মিঃ বার্টলেট মেয়েটিকে নামিয়ে নিয়ে যায় এবং চৌকিদার পরমেশ্বর দুবের হেফাজতে তাকে কিছুক্ষণ রাখা হয়। সময়টা ছিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে, স্টেশনের সব বাতিগুলোই তখন জ্বলে উঠেছিল।

এরপর পরমেশ্বর দুবে মেয়েটিকে টিকিট কালেক্টরের ঘরে নিয়ে যায়। মিঃ বার্টলেট এবং আরও পাঁচজন সাহেব আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল। দুবেকে একটি রেকর্ড বই এবং কিছু টাকা দিয়ে অবিলম্বে অফিসঘর ছেড়ে চলে যেতে বলা হয় এবং মেয়েটিকেও নির্দেশ দেওয়া হয় তখনি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে  যেতে। তবে সঠিক গেট দিয়ে নয় বরং অন্য একটি পথে স্টেশন ছেড়ে তাকে বেরোতে হয়। সেই পথ আসলে সাহেবদের কোয়ার্টারের দিকে যায়। সঙ্গে থাকা সামান্য মুড়ি সম্বল করে, কোনমতে রাত্রিযাপন করার জন্য রাজবালা আসানসোল বাজারের দিকে হাঁটতে থাকলে আরেকবার হঠাৎ করে সে সাহেবদের মুখোমুখি হয়। প্রথমে সেই পাঁচজনের মধ্যে দুজন সাহেব তার দিকে এগিয়ে আসে, গ্রেফতারের ভয় দেখায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি তিনজন সাহেবও সেখানে এসে  হাজির হয়। তারা এবার জোর করে রাজবালাকে স্টেশনের মূল ভবন থেকে মাত্র ৫00 বা ৬00 গজ দূরে একটি ঘরে তুলে নিয়ে যায়। সেইখানে ওই পাঁচ সাহেবের মধ্যে চারজন তাকে পালা করে ধর্ষণ করে। প্রথমে আসে বার্টলেট, তারপর অ্যালিসন, তারপর ডি’সুজা এবং সবশেষে কাওলি। মুডি ছিল পঞ্চম জন। সে বাইরের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইখানে দাঁড়িয়ে সে ধর্ষকদের পাহারা দিচ্ছিল।

রাজবালাকে জবরদস্তি টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলে সে প্রাণপণে চিৎকার করবার চেষ্টা করে এবং তাকে বাধা দেওয়া হয়। হাত দিয়ে তার মুখ সজোরে চেপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধর্ষণ শেষ হওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে সে বিধ্বস্ত অবস্থায় সোজা স্টেশনের এনকোয়্যারির দিকে ছুটে যায়, যাতে সেখানে নিজের অভিযোগ জানাতে পারে। সেইখানে আর এক চৌকিদার রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে তার মুখোমুখি হয়। রঘুনাথই তাকে স্টেশন মাস্টার মিস্টার লাভের কাছে নিয়ে যায় এবং রাজবালা তখনি ধর্ষক সাহেবদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। রাত তখন প্রায় ১০.১৫।

পুলিশের হেড কনস্টেবল বসন্ত কুমার গুহ রাত ১২ টায় তদন্ত শুরু করেন এবং পরের দিন অন্য এক স্টেশন মাস্টার মিঃ ম্যাককার্থি নয়জনকে অভিযুক্তকে (ডি’সুজা, মুডি, অ্যালিসন, বার্টলেট, উরকুহার্ট, ডি’সিলভা, হাবার, পাওয়ার ও ল্যান্ডম্যান) শনাক্তকরণের জন্য এক সারিতে দাঁড় করিয়ে রাজবালাকে ডেকে পাঠান। রাজবালার যথেষ্ট সাহস ছিল সন্দেহ নেই। সে তৎক্ষনাৎ ডি’সুজা, অ্যালিসন এবং বার্টলেটকে ধর্ষণকারী এবং মুডিকে তাদের সাহায্যকারী হিসাবে চিহ্নিত করে। কাওলি সেই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিল না। বিকেল ৪টার সময় তাকেও তুলে আনে পুলিশ। মামলা রুজু হয়। আদালতে মামলাটি প্রমাণ করতে রাজবালাসহ নয়জন সাক্ষীকে জেরা করেন সরকারপক্ষ।

প্রথম সাক্ষী ছিল রাজবালা নিজেই। সে সব লজ্জা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ ঘটনার বিশদ বিবরণ দেয়। খোলাখুলিভাবে বলে কীভাবে তাকে ভয় দেখিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এবং অন্য সবকিছু।

পরবর্তী সাক্ষী ছিলেন সহকারী সার্জন ডাঃ কাশীনাথ ঘোষ। ৯ মে সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে তিনি রাজবালাকে পরীক্ষা করেন। রাজবালার শরীরে বলপূর্বক সংগম করা হয়েছে এই নিয়ে তাঁর মনে কোন সন্দেহই ছিল না।

তৃতীয় সাক্ষী ছিলেন মিস্টার লাভ। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনিই ছিলেন স্টেশন মাস্টার। রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে রাজবালা তাঁর কাছেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছিল। সে তাঁকে সেই ঘরটিও দেখিয়েছিল যেখানে সাহেবরা একে একে তার শ্লীলতাহানি করে।

পরবর্তী সাক্ষী ছিল রঘুনাথ সিং। ধর্ষণের পরপরই তার সঙ্গে দেখা করে রাজবালা।

পঞ্চম সাক্ষী ছিল পরমেশ্বর দুবে, যে আদালতে নিশ্চিত করেছিল বার্টলেটই রাজবালাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

ষষ্ঠ ও সপ্তম সাক্ষী ছিল টিকারাম কাহার ও সেলিম সিং। আসানসোল স্টেশনের ওভারব্রিজে সেই সন্ধ্যায় ডিউটি ​​করছিল তারা। তারা দু-জনেই নিশ্চিত করে যে ৮ই মে, রাজবালাকে একটি ছোট বান্ডিল হাতে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে কিছু সাহেবের সঙ্গে রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কোয়ার্টারের দিকে যেতে দেখেছে।

অষ্টম সাক্ষী ছিল রেলের আর এক চৌকিদার কুঞ্জবিহারী তেওয়ারি। ৮ই মে রাতে সে তার রাউন্ডে ছিল। রাত ৯টার দিকে সে চিহ্নিত রেলওয়ে কোয়ার্টার থেকে এক নারীর চিৎকার শুনতে পায়।

ল্যান্ডম্যান, টিকিট সংগ্রহকারী— পরবর্তী সাক্ষী। সে রাজবালা, বার্টলেট এবং অন্য তিন অভিযুক্তের পরিচয়ে জবানবন্দি পেশ করে।

আর চূড়ান্ত সাক্ষী ছিলেন তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ হেড কনস্টেবল বসন্ত কুমার ঘোষ।

এরপর এই মামলা রানীগঞ্জ আদালত থেকে বর্ধমানের দায়রা আদালতে চলে যায় এবং অবশেষে বিচারের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। মাননীয় বিচারপতি জেম্‌স ম্যাকফারসন এবং বিচারপতি গুরুদাস ব্যানার্জির ডিভিসন বেঞ্চে ২২ এবং ২৩ আগস্ট মামলার শুনানি হয়। দুই, বিচারপতির মতামতের পার্থক্য ছিল। বিচারপতি ম্যাকফারসন যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ পাননি যে সাহেবরা সত্যিই মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে। অন্য দিকে বিচারপতি ব্যানার্জির বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না যে বার্টলেটই নির্যাতিতাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার সন্মানহানি করেছে। শনিবার, ৭ই সেপ্টেম্বর, বাংলার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার কোমার পেথারাম স্বয়ং এই মামলার শুনানি করেন। অ্যাডভোকেট জ্যাকসন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং অ্যাডভোকেট অ্যাভেটুম, বার্টলেট এবং অন্যান্য বন্দিদের প্রতিনিধিত্ব করেন। সব পক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর এক ঐতিহাসিক রায়দান করা হয়।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি, রাজবালার কাহিনি সত্য বলেই উপসংহারে আসেন। তিনি বার্টলেটকেই অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। ধর্ষণের অপরাধে দোষী প্রমাণ হয়ে বার্টলেট পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। ডি’সুজা মামলা চলাকালিন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ফেরার হয়ে যায়। বাকিরা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে শেষপযর্ন্ত ছাড়া পেয়ে যায়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির অভিমত ছিল, এমন ঘটনা যাতে আর কখনই পুনরাবৃত্ত না হয় সেই বিষয়ে সঠিক এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি মাননীয় বিচারপতি গুরুদাস ব্যানার্জির সাথে একেবারে একমত ছিলেন এবং ম্যাকফারসনের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন।

এরপর স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তো আসানসোল স্টেশনের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। একই তালে আমরাও ক্রমাগত রাজবালাকেও ভুলে গিয়েছি। যেদিন ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার পি কে মিশ্র মশাই-এর সহযোগিতায় আমরা এই রেল স্টেশনকে হেরিটেজ তকমা দেওয়াতেও সক্ষম হয়েছিলাম, আনন্দের প্লাবনে ভাসছিলাম, সেদিন ভাবতেও পারিনি রেলোপলিস হলে পুরোনো স্টেশন বিল্ডিংটাই আগে ভেঙে ফেলা হবে।

আমরা তো রাজবালাকে, তার সাহস ও সংগ্রামকে মনে রাখিনি। আগামী প্রজন্ম কেনই বা এই ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন স্টেশন বিল্ডিংটিকে, এবং আমাদের ঐতিহ্যপ্রেমের রোম্যান্টিক পাগলামিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকবে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়লাকুঠির জীবনকে যিনি প্রাণপণে সাহিত্যের পাতায় আর্কাইভ করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়েরও এই আসানসোল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক পুরোনো বন্ধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হয়ে মনে হয়েছিল, সময় কত শক্তিমান আর মানুষের স্মৃতি কতই না দূর্বল। সমাজের কাছে কখনো কখনো তা বড়োই অপ্রাসঙ্গিক।

তাই, যদিও কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে।

 

ডান্ডি কেকের কথা

শৈলজানন্দের প্রাণের বন্ধু নজরুল একসময় আসানসোলে এক বেকারির দোকানে খাতা লেখার কাজ করতেন। দোকানটি আসানসোল বাজারে এখনও বেশ টিকে রয়েছে— এম এ বক্স অ্যান্ড সন্স। যদিও বিগত চার বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা চেষ্টা চালিয়েও আমরা আসানসোল মিউনিসিপ্যাল ​​কর্পোরেশনকে দিয়ে একটি ফলক বা অন্তত একটি হেরিটেজ সার্টিফিকেট তৈরি করিয়ে এই ঐতিহ্যমন্ডিত দোকানের মালিককে সম্মানিত করতে বিফল হয়েছি। অথচ এই আসানসোলেই নজরুলের নামে রাস্তা রয়েছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-অকাডেমি-রিসার্চ সেন্টার, এমনকি বিমানবন্দরও রয়েছে। নজরুলের জন্মভূমি কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় এদেশের ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং আরও কত বিদগ্ধজনের অহরহ আনাগোনা। রেলোপলিস হলে যখন শহরের ভোল একেবারে পাল্টে ফেলা হবে, তখন সম্ভবত আজকের আসানসোল বাজারও থাকবে না, আর এই দোকানটাও থাকবে না। শৈলজানন্দের লেখায় সেই যুগের নজরুল অবশ্য আরও কিছুদিন থাকবেন আশা করি। গল্প মুখে মুখে ঘোরে আর অনেকদিন বাঁচে। আর তাই নজরুলের নিজের লেখায়, পেটের দায়ে চা বাগানে কাজ করতে রাজি হওয়া সেই কুলিদের কথাও থাকবে যাঁরা পশুর মতো গাদাগাদি করে পড়ে থাকতে বাধ্য হতেন আসানসোলের রেলপাড়— ডিপোপাড়ার গুদামে, উপযুক্ত ডাক্তারি পরীক্ষার পর সুদূরে চা বাগান মালিকের আশ্রয়ে সারাজীবনের জন্য চালান হয়ে যাবার কিছুদিন আগে। আমাদের সেদিকে তাকানোর অবকাশও থাকবে না, সেটা তো আলাদা কথা।

সমাজে আসলে সেটুকুই মূল্যবান যা নিয়ে বেশ জমিয়ে ব্যবসা করা যায়। আর যা দিয়ে ব্যবসা হয় না, তা একেবারে হারিয়ে যায় কিংবা তাকে আর্কাইভে রাখা হয়। নজরুলের নাটক থেকেই নাম ধার করে, তাঁরই নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই “সেতুবন্ধ” মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। আজ যখন প্রতি সপ্তাহেই আমাদের জীবনের অনেক ভালোবাসার ধন পুরোনো আর বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তখন গোটা অতীতটাকে নির্বিচারে ধাপার মাঠে পাঠানোর আগে এই “সেতুবন্ধ” মিউজিয়ামে একবার খবর দেওয়ার অনুরোধ করে চলেছি, যাতে কণামাত্র অন্তত সংরক্ষণ করা যায়।

নজরুলের পাশাপাশি শৈলজানন্দের সাহিত্যও এই মিউজিয়ামের প্রধান অনুপ্রেরণা। আর রয়েছেন ইউভাল নোওয়া হারারি, যিনি আজকের দিনে এই চটপট সবকিছু বাতিল করার ভয়ংকর প্রবণতার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ কেমন করে নিজের শুভবুদ্ধি প্রয়োগ করে রুখে দাঁড়াবে, সেই আদর্শের প্রধান তাত্ত্বিক।

অবশ্য আসানসোল  শহরে কাজ করতে আসা কুলিদের ইতিহাস আরও অনেক পুরোনো, শৈলজানন্দ-নজরুলের চেয়েও পুরোনো। তাদের কথাই এবার বলতে চাই প্রকারান্তরে, ঐ বেকারি ব্যবসার সূত্র ধরেই।

      

আসানসোলের কিছু মুসলিম রুটি-কেক ব্যবসায়ী, মোটামুটিভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে রেল স্টেশনের ইউরোপিয়ান কলোনি সংলগ্ন বস্তিন বাজার এলাকায় দোকান দিয়ে এসেছেন। এখন যাঁরা দোকান চালান, তাঁদের সেইসব পূর্বপুরুষ সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী দিনগুলিতে প্রতিবেশী রাজ্য বিহার থেকে রেলে শ্রমিকের কাজ করতেই এসেছিলেন। এক বিখ্যাত দোকান মিনার বেকারি শপের বর্তমান মালিকের এমনই এক পূর্বপুরুষ, এক স্কটিশ রেলওয়ে অফিসারের (সম্ভবত এক ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট) রান্নাঘরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানেই নানা ধরনের ইউরোপিয়ান পদের পাশাপাশি একটি বিশেষ কেক বেক করার বিশদ প্রক্রিয়াও তিনি রপ্ত করেন। এই কেকেরই নাম ডান্ডি কেক, জন্ম স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরে, জ্যানেট কেইলার নামে বেকারের আভেনে, সেই ষোড়শ শতাব্দিতে মেরি কুইন অফ্‌ স্কট্‌স-এর সময়। উপনিবেশ এবং রেলপথের বিস্তারের হাত ধরে এই সুখাদ্য আসানসোলে এসে পৌঁছালে, এক রেল শ্রমিকের হাতে তার নবজন্ম হলো। সেই মানুষটিই তৎকালীন সদ্য-প্রতিষ্ঠিত বাজারে যে আসানসোল-ডান্ডি কেক এখানকার ক্রেতার রসনার উপযুক্ত করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি করলেন এবং প্রথাগত খাদ্যরুচীর বড়োসড়ো পরিবর্তন সাধন করলেন, পরবর্তী দেড়শো বছর ধরে তাঁরই উত্তর-প্রজন্ম বড়দিনের সময় থেকে শুরু করে নতুন বছরের আগমণ পর্যন্ত একই পদ তৈরি করে আসছেন।

আমাদের আসানসোল হেরিটেজ রিসার্চ গ্রুপ আক্ষরিক অর্থেই যাত্রা শুরু করেছিল এই সুখাদ্যটিকে চিহ্নিত করে। কেকওয়াকও বলতে পারেন। ঠিক সেই সময়েই স্কটিশ বেকাররা তাঁদের ডান্ডি কেকের অথেনটিসিটির জন্য জিআই দাবি করেছিল, আর বাংলায় রসোগোল্লার অধিকারের দাবিতেও বেশ কিছু মানুষ সরব হয়ে উঠেছিল। দুটো ক্ষেত্রেই কালক্রমে সাফল্য লাভ হয়েছে। যদিও সেদিক থেকে দেখতে গেলে আসানসোল-ডান্ডি কেক নিয়ে, বা বলা চলে সুস্পষ্টভাবে আমাদের রেল-শহরের কোলোনিয়াল হাইব্রিড ঐতিহ্য নিয়ে এদেশে কেউ সেরকম উৎসাহ দেখাননি।

অথচ এই নিয়ে জন-সচেতনতার চেষ্টা আমরা যথেষ্টই করেছি। ২০১৬ সালের শীতকালে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিষয়টি প্রথমবার উপস্থাপনা করা হয়। পরে আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গান নামে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে আসানসোল-ডান্ডির গল্প প্রকাশিত হয়। এরপর এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ একটি দলকে আসানসোল পরিদর্শন করতে ও এই কেকের স্বাদ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁদের অভিমত নির্দিষ্ট ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে দেশের ভিতরে বারবার তুলে ধরে সুখাদ্যটিকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টাও করা হয়েছে। এই নিয়ে খুব শীঘ্রই রাটলেজ ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিতব্য একটি বইয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধও সংযোজিত হবে। দোকান মালিক অবশ্য আপাতত খুব খুশি; ইদানীং তাঁর কিছু খদ্দের বেড়েছে। কিন্তু এই পর্যন্তই। মালটিন্যাশনালদের খুচরো ব্যবসার চাপে আসানসোল-ডান্ডি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে সে তো দুরাশা। রাজবালার মতোই, আসানসোল স্টেশনের বিল্ডিংটির মতোই এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী, ঐতিহ্যের অঙ্গ এই সুখাদ্যটিকেও আমরা আস্তে আস্তে ভুলে যাব।

 

ডুরান্ড ইনস্টিটিউট 

যখন পূর্ব রেলের আসানসোল বিভাগের তৎকালীন ব্যবস্থাপক— পি কে মিশ্র মশাইকে আসানসোল-ডান্ডির গল্প শোনাই এবং আসানসোলের রেলওয়ে হেরিটেজ সম্পর্কে আরও অনেক পুরোনো কাহিনি সংগ্রহ করার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানাই, তিনি অনায়াসেই সম্মত হয়েছিলেন। এছাড়া ঊনবিংশ শতকের অন্যতম রেল স্থাপত্য ডুরান্ড ইনস্টিটিউট সংস্কারের প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে তিনি আমাদের সাহায্যও চেয়েছিলেন। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই রেল ইনস্টিটিউট আসলে ভারতের বুকে পূর্ব ভারতীয় রেলওয়ের প্রথম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রেল অফিসারদের সবচেয়ে বড়ো বিনোদনমূলক ক্লাব এবং কালক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মারক। চিত্রশিল্পী রথিন মিত্র ডুরান্ড ইনস্টিটিউট নিয়ে লিখেছেন, এর ছবিও এঁকেছেন। আর অস্ট্রেলিয় গায়ক টেরি মরিস একাধিক গান বেঁধেছেন ডুরান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি নিয়ে।

২০১৮-১৯ সালে ডুরান্ড ইনস্টিটিউটের পুরোনো মানচিত্র, নকশা, নথি, ছবি, বই, আসবাবপত্র, ঘড়ি, খেলাধুলোর সরঞ্জাম, রুপোর তৈরি অসাধারণ সমস্ত ট্রফি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের স্মৃতিকথা— সব জোগাড় টোগাড় করে, ক্ষেত্র-সমীক্ষা ভিত্তিক একটি ব্রোশিওর এবং কফি টেবিল বই আমরা তৈরি করি। পরে তাই দিয়ে একটি ছোট তথ্যচিত্রও তৈরি হয়। ইনট্যাক, রেলওয়ে এনথুসিয়্যাস্ট সোসাইটি, ফ্রিম্যাসনস হল, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন স্থানীয় স্কুলের সহযোগিতায় কয়েকটি হেরিটেজ ওয়াকের আয়োজনও আমরা করি। আসানসোলের বিভাগীয় রেলওয়ে পরবর্তী কালে একের পর এক ত্রিশটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে আমাদেরই দেখানো পথে সেগুলির পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু পি কে মিশ্র মশাই বদলি হয়ে যাওয়ার পর সার্বিক অবস্থার এক হঠাৎ এবং আমূল পরিবর্তন হয়।

ঔপনিবেশিক যুগে ক্রিশমাসে কলকাতা থেকে সাহারানপুর, নানা দিক থেকে সাদা মানুষেরা এসে নাচে, গানে, কার্নিভালের হুল্লোড়ে ডুরান্ড ইনস্টিটিউট মাতিয়ে রাখতেন। বিংশ শতকের সাতের দশকের শেষপর্যন্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা খানিকটা হলেও এই পরম্পরা কায়েম রেখেছিলেন। তারপর ডুরান্ডের নাম বদলে বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট রাখা হল। তখনও এখানে অনুষ্ঠান করেছেন বিদূষী সুনন্দা পট্টনায়ক, উস্তাদ বিসমিল্লা খান প্রমুখ। আসানসোলে ফিল্ম সংস্কৃতির আমদানি হয় প্রথম এখানেই। ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস, ফুটবল, সাঁতার, বিলিয়ার্ডস এবং ঘোড়দৌড় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ইনস্টিটিউটকে ঘিরেই। যদিও রেলোপলিস তৈরি হলে, এই সুরভিত স্মৃতির কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে বলা মুশকিল। হয়তো পুরো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না ডুরান্ড ইনস্টিটিউট, কিন্তু তার কমার্শিয়্যাল ইউজ দস্তুরমতো করা হবে। রেলের জমি ঘিরে কর্পোরেট কেতায় ওয়ার্ক, প্লে, রাইড, লিভ— এই মূল নীতিতে বিশ্বাসী আজকের রেল মন্ত্রক, মালটিন্যাশনালদের হাতে হাত রেখে নানাভাবে ডুরান্ডের বিপণনে নামবে, আর তাতেই এর ঐতিহ্যে লাগবে কালিমা। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আসানসোলবাসীর সঙ্গে তাদের সাধের ডুরান্ডের নাড়ির যোগ যাবে একেবারে ছিন্ন হয়ে।

বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট এইভাবে মালটিন্যাশনালের হাতে বেচে দেওয়া হবে।

 

ফ্রিম্যাসনদের গল্প

ডুরান্ডের অদূরেই রয়েছে লজ পাইওনিয়ার-ফ্রিম্যাসনস হল যার প্রতিষ্ঠা হয় সেই ১৮৭৬ সালে এবং বর্তমানে এটিই পূর্বভারতের প্রাচীনতম ফ্রিম্যাসনিক ভবন। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিংও কম বয়সে এখানে এসেছিলেন। তাঁর একাধিক লেখায় আসানসোল এবং এখানকার ফ্রিম্যাসনদের উল্লেখ রয়েছে।

এখনও ব্রিটিশ সংবিধানের অধীনে থাকা এই সিক্রেট সোসাইটির বর্তমান সদস্যেরা সকলেই স্থানীয় মানুষ এবং আমাদের অনুরোধেই এযাবৎ তাঁরা নানা হেরিটেজ ওয়াকে যোগ দিয়েছেন। বাস্তবে আসানসোলের ঔপনিবেশিক যুগের সবচেয়ে পুরোনো এই অসাধারণ বাড়িটির অধিকার নিয়ে কয়েক দশকের আইনি লড়াইয়ে রেলওয়ের সঙ্গে ফ্রিম্যাসনদের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত। রেলোপলিসকে কেন্দ্র করে এই তিক্ততা আরও বেড়েছে। রেলওয়ে চায় অবিলম্বে ভবনটি খালি করে ফ্রিম্যাসনরা অন্য কোথাও চলে যাক যাতে এই স্থাপত্যটিরও উপযুক্ত কমার্শিয়াল ইউজ হয়। তবে ফ্রিম্যাসনদের কাছে রয়েছে খুব পুরোনো কিছু নথি, নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আর ভূত বাংলো হিসেবে বিল্ডিংটির কুখ্যাতি, যা তাঁদের বারবার রক্ষা করেছে। তবে এখন সন্দেহ হচ্ছে ভূত আর ভবিষ্যতের এই এপিক ব্যাটেলে এভাবে আর তাঁরা কতদিন নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে  পারবেন।

আমরা অনেকেই তো ড্যান ব্রাউনের লেখা পড়েছি। তাই বিশ্বের প্রেক্ষিতে ফ্রিম্যাসনদের ভূমিকা নিয়ে নতুন কিছুই বলার নেই। শুধু এটুকু মনে করিয়ে দিতে চাই যে এদেশেও স্বামী বিবেকানন্দ, গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোতিলাল নেহরুর মতো মানুষেরা ফ্রিম্যাসন ছিলেন। ইতিমধ্যেই একটি ইংরাজি প্রবন্ধে আসানসোলে ফ্রিম্যাসনদের গুরুত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করবার চেষ্টা করেছি। সেখান থেকে সূত্র নিয়েই বলতে পারি, অতীতের সদ্য-আধুনিক আসানসোলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রধান সূত্র হিসেবে কাজ করে এসেছে এই লজ পাইওনিয়ার-ফ্রিম্যাসনস হল, এবং সেই কাজ সে আজও ধীরে ধীরে করছে। তাই সাংস্কৃতিক ঐক্যের মন্দির এই ভবনে হস্তক্ষেপ করার ফল সামাজিকভাবে বিষময় হতে পারে।

রেলোপলিস নির্মাতাদের সত্যিই কি কোন অধিকার আছে এই ভবন অপবিত্র করার?

আমরা তবুও ফ্রিম্যাসনদের সঙ্গে রেলওয়ের সুসম্পর্ক স্থাপনের একটা প্রচেষ্টা প্রথম থেকেই করে এসেছি। তাতে হয়তো বরফ খানিকটা গলেছিল। রেলকর্মীরা বিগত পঞ্চাশ বছরে একবারের মতো অমূল্য ফ্রিম্যাসনিক ঐতিহ্য নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করতে এসেছিলেন। ফ্রিম্যাসনদের প্রাঙ্গনে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সিভিল সোসাইটির মানুষদের সেখানে একাধিকবার ডেকে এনে আমরা এই ভবনটি জোর করে দখল করা বা ফ্রিম্যাসনদের এখান থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদও করি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রবল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর সদিচ্ছার জোর আর খাটবে না। ফ্রিম্যাসনদের অস্তিত্ব আসানসোলে অবলুপ্ত হবে।

যেদিন ফ্রিম্যাসনস হলে এডিনবার্গ কলেজ অফ আর্ট-এর ইন্টেরিয়র ডিজাইনের অধ্যাপক এডওয়ার্ড হলিসের একটি বক্তব্যসভার আয়োজন করেছিলাম, সেখানে এলাকার শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, ও ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই হাজির হয়েছিলেন। ফলস্বরূপ “রেলওয়ে হেরিটেজ” ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয় ভবনটির গায়ে। কিন্তু সেই ট্যাগ খোলা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আসানসোল রেলবিভাগের বর্তমান ব্যবস্থাপক নিশ্চয়ই আইনি জটিলতার কারণে নয়া দিল্লি থেকে এখনও স্পষ্ট নির্দেশ পাননি, আর তাই কোমর বেঁধে ফ্রিম্যাসন তাড়ানোর অভিযানে নামতে পারেননি। তবে আদালতের একটিও রায়ও রেলওয়ের পক্ষে গেলে, দু-শো বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিনাশ সাধিত হবে।

আমাদের কিই বা দেবার আছে

আসানসোল তো কোনভাবেই ভারত বা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়; এখানে না আছে আগ্রার তাজমহল, না বারাণসীর ঘাট, না পুরীর সমুদ্র, না উটির সবুজ পাহাড়। তাই পর্যটক ডেকে আনার জন্য সেরকম কোন পিকচার পোস্টকার্ড তৈরি করা এখানে সম্ভব নয় এখানে। তবু আমার বারো বছরের মেয়েকে বললাম, দে না মা দুটো ছবি এঁকে এমন কিছুর যা দেখিয়ে মানুষকে বলা যায়— এই আছে আসানসোলে। তা সে যা আঁকল, তারই মধ্যে কয়েকটা জুড়ে দিয়েছি এই প্রবন্ধের সঙ্গে। এতদিন আমাদের কাছে যা যা গল্প শুনেছে, আর নিজে চোখে দেখে যেটুকু বুঝেছে, তাই দিয়েই সে এঁকেছে।

মেয়ের কাছে যা রেখে ঢেকে বলি, সেগুলোই এই লেখায় খানিকটা খোলাখুলিভাবে বলতে পারলাম এটাই একটা বড় স্বস্তি। এই ধরনের গল্পগুলো মনে হয় বারে বারে বলা দরকার। গল্পগুলোর সঙ্গে যে-স্মৃতি বিজড়িত, তা কিছুটা হলেও মানুষের মোহ নাশ করবে; বিকাশের মোহ যা দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে বিনাশের পথে। আসানসোল হেরিটেজ রিসার্চ গ্রুপ এই গল্পগুলো ক্রমাগত তুলে ধরেই তো যৎসামান্য করে উঠতে পেরেছে। সবাই মিলে বললে আরো কিছুদিন যদি আমাদের অস্তিত্বের সার্বিক অবলুপ্তি ঠেকানো যায়। হেরিটেজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞতার তো প্রশ্নই ওঠে না, আমরা নিজেদের একরকম “হেরিটেজ ইন্ডাস্ট্রি” থেকে বহুদূরে সরিয়ে রেখেছি। আর তাতেই কিছু মানুষের আস্থা লাভ করতে পেরেছি এপর্যন্ত, তাদের মধ্যে সামান্য হলেও ইতিবাচক স্পন্দন তৈরি করা গেছে।

দেশের সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে আসানসোলকে রেলোপলিস উপহার দেবেই। কিন্তু অত মূল্যবান না হলেও, খুবই সামান্য কিছু তো আমাদের পরস্পরকে এবং আগামী প্রজন্মকে দেওয়ার আছে।

ঋণস্বীকার:

সজল কুমার ভট্টাচার্য, শুভজিত চ্যাটার্জি, হেমন্ত মন্ডল, অনির্বাণ ব্যানার্জী, শুভজিৎ সরকার, বৈভবী ব্যানার্জি, আদনান হাসান, অরুণাংশু আলি চৌধুরী, ভুতনাথ মণ্ডল, মনোজ কুমার সিং, তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়দীপ চক্রবর্তী, কমল ব্যানার্জি , সৌরভ নিয়োগী, পল গিলিং এবং কমলিকা বোস।

তথ্যসূত্র:

http://irsdc.in/sites/default/files/03-JGM%20UD&P%20IRSDC-%20Layout%20Planning%20and%20PDCs.pdf

http://www.daathvoyagejournal.com/imagebag/image431.pdf

https://er.indianrailways.gov.in/view_section.jsp?fontColor=black&backgroundColor=LIGHTSTEELBLUE&lang=0&id=0,6,443,528,538

https://government.economictimes.indiatimes.com/news/smart-infra/railpolis-irsdc-codes-for-station-redevelopment-and-commercial-development-on-railway-lands/82174394

https://ideas.ted.com/the-rise-of-the-useless-class/

https://travel.economictimes.indiatimes.com/news/railways/railopolis-how-todays-railways-stations-are-being-turned-into-mini-smart-cities/84750369

https://www.google.com/search?q=asansol+heritage+research+group&sxsrf=ALiCzsYE2BkDierT1HAW9gJEgCLV_2Au_g%3A1652080870822&ei=5sB4Ys7jMevWz7sP_u6psAo&oq\

https://www.knu.ac.in/get-page-details-sub-category/setubandha-the-knu-museum/71

https://www.nationalheraldindia.com/india/modi-govt-denied-it-on-floor-of-parliament-but-indian-railways-privatisation-well-on-track

https://www.research.ed.ac.uk/en/publications/asansol-unfinished-biography-of-a-raj-era-railway-town-exploratio/fingerprints/

https://www.telegraphindia.com/culture/hot-on-the-trail-of-the-dundee-cake/cid/1680923

লেখক পরিচিতি:

ড. শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ-অধ্যাপক, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসানসোল,পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।

ই-মেইল: knusantanu@gmail.com

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *