চল্লিশের সংকট, বাংলা কবিতা ও কিছু ভাবনা

সু নি মা ঘো ষ

“… মানবেতিহাসে মাঝে মাঝে আসে মলমাস” [১] 

 

কবি কথিত সেই মলমাসের মধ্যে দিয়েই বর্তমান মানব সমাজের দিন অতিবাহিত হচ্ছে;  যেখানে  কোন কিছুই শুভ নয়, সব যেন এক অজানা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে আছে। এই আতঙ্ক কেবল ভাইরাসের কারণে মৃত্যুজনিত নয় বরং ভাইরাসকে ঢাল করে অর্থনৈতিক বিপন্নতা, সাংস্কৃতিক বিপন্নতা, শিক্ষার বিপন্নতা, মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। আর এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আশঙ্কা। এই সর্বগ্রাসী সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের মনে পড়ে স্বাধীনতার পূর্বে চল্লিশ দশককে, সেইসময়ও বাঙালির জনজীবন যুদ্ধের পটভূমিতে মন্বন্তর, মহামারি, দাঙ্গা, দেশভাগের বিপর্যয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাঙালি হারেনি, সেই সংকটকে তারা কাটিয়ে উঠে এক নতুন সত্তা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিল। আর ঠিক সেই কারণেই এই নিবন্ধে আমরা ফিরে দেখব চল্লিশের সংকট ও তার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট কবিতাকে। কারণ ইতিহাস আমাদের তথ্য দেয়, আর সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা দেয় অন্তর্দৃষ্টি, যা আমাদের এই সংকট থেকে পরিত্রাণের পথ দেখাবে। পৃথিবীর এই গভীর গভীরতর অসুখেও আমাদের মনে রাখতে হবে কবির সেই অমোঘ পংক্তি, ‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা/ সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।’ [২] কবির এই বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই আমদের আজকের অমলরূপী জীবনে সুধার স্পর্শলাভে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, অতীতের পানে ফিরে তাকিয়েছি। যেখানে কবিরা চল্লিশের সংকটের অসহায়তার‌ দৃশ্যরচনার সঙ্গেসঙ্গে প্রতিরোধের দৃশ্যকেও তুলে ধরেছেন। 

 

কিন্তু কোনো বিশেষ সময়ের প্রেক্ষিতে সাহিত্য পর্যালোচনায় অগ্রসর হওয়ার পূর্বে আমাদের সেই সময় সম্পর্কে সম্যক ধারণার প্রয়োজন। চল্লিশের দশকের সূচনাই হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সঙ্গে করে। যদিও যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল না আমাদের দেশ, কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার কারণে, ক্ষমতাবানের ইচ্ছাতেই জড়িয়ে যায় ভারত তথা ভারতবাসী। বলা যায় চল্লিশের বাংলা তথা ভারতে যে সংকট দেখা গিয়েছিল তার প্রেক্ষাপটরূপে কাজ করে বিশ্বযুদ্ধ। যেমন ধরা যাক মন্বন্তর— ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বুকে যা সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসে তা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। সরকারের তরফ থেকে এর প্রাকৃতিক কারণ জানানো হয়— ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের অনাবৃষ্টি এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলার ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী কিছু জেলায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। যেই জলোচ্ছ্বাসের ফলে খাদ্যশস্য ভেসে যায় এবং রোপণ করা ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন সরকারি রিপোর্টে এই তথ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, কিন্তু অমর্ত্য সেন থেকে বর্তমানে মধুশ্রী মুখার্জিসহ আরও অনেকেই তাঁদের গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন, প্রাকৃতিক কারণ প্রেক্ষাপটরূপে কাজ করলেও ক্ষমতাবানের ভুলনীতির জন্যই দুর্ভিক্ষ গড়ে ওঠে, কেবল তাই নয় এর প্রতিরোধেও সরকার কোনো সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেনি। যেমন অমর্ত্য সেন তাঁর Poverty and Famines গ্রন্থে বিভিন্ন সারণীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন মন্বন্তরের বছরে‌ খাদ্য শস্যের উৎপাদন বা সংরক্ষণ পূর্ববর্তী বা পরবর্তীর তুলনায় এমন কিছু কম ছিল না। আর সে-কথা তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— 

“It seems safe to conclude that the disastrous Bengal famine was not the, reflection of a remarkable over-all shortage of foodgrains in Bengal” [৩] তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র রিপোর্ট দেখলেও এই ধারণার সত্যতা প্রমাণিত হয়। যেমন ধরাযাক ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে উৎপাদিত ধানের পরিমাণের সঙ্গে বিগত কয়েক বছরের যদি ধান উৎপাদনের তুলনা করা যায়, দেখব ১৯৪৩-এ এত কম উৎপাদনও হয়নি, যে তা দুর্ভিক্ষ ডেকে আনতে পারে। নিম্নে সারণীটি দেওয়া হল: 

 

খ্রিস্টাব্দ           

আমন ধান 

(টন) 

আউস ধান (টন)  

বোরো ধান 

(টন)

১৯৪০        

৬,৫০৪,০০০        

১,৫২৫,০০০         

১৯৪,০০০

১৯৪১        

৪,৩১৫,০০০        

২,২৫০,০০০        

২০৩,০০০

১৯৪২       

৭,৩৯৬,০০০        

১,৬৯৪,০০০        

২০৬,০০০

১৯৪৩       

৫,০২০,০০০        

২,৩৯০,০০০        

২১৮,০০০ (৪)

 

দুর্ভিক্ষ কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, আমন ধানের উৎপাদন কম হলেও পূর্ববর্তী বছরের উদ্বৃত্ত দিয়েও অন্যান্য ধানের উৎপাদনে খাদ্যশস্যের ঘাটতি মেটানো যেত। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেইসময় বহু সৈন্যের আবির্ভাব ঘটে, এছাড়া যুদ্ধের উপকরণ নির্মাণে বহু শ্রমিক এসেছিল যাদের জন্য প্রচুর খাদ্যশস্য বাজার থেকে বেশি তুলতে শুরু করে সরকার। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৪১-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে যেখানে সরকার চাল কেনে ৪৭হাজার টন, সেখানে ১৯৪২-১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লক্ষ ১৫ হাজার টন। [৫] তৎকালীন বাণিজ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সদস্য নলিনীরঞ্জন সরকারের বক্তব্যে এই তথ্যেরই সমর্থন মেলে।

“Large scale purchases are made on behalf of the army increasing requirement of our Defence Forces” [৬]

ব্রহ্মদেশ থেকে জাপানি আক্রমণের ভয়ে শরণার্থীর প্রবেশ খাদ্য সংকটের অন্যতম বড় কারণ। সবচেয়ে বড়কথা যুদ্ধের কৌশলরূপে জাপানিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপকূলবর্তী অঞ্চলে সরকার ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দেয়, সেইসঙ্গে খাদ্যশস্য বহনকারী নৌকাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই নীতি যে কৃষি ও খাদ্যশস্যের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছিল তা বুঝতে পেরেই তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক গভর্নরকে চিঠিতে লেখেন,

“Rice removal policy and boat removal policy… the most outstanding instance of blunder.” [৭]

এইসব যুদ্ধের প্রয়োজনে গৃহীত নীতিগুলি ছাড়াও, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের প্রচেষ্টা না করে যাতে তা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তার জন্যই সরকার বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেমন খাদ্যশস্য গ্রহণ ও বন্টনে এজেন্ট নিয়োগ করে, যাতে দুর্নীতি আরো বেড়ে যায়, চোরাকারবারদের ব্যবসা রমরমিয়ে ওঠে। বিশেষ করে নোট বাজারে ছাড়ায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে। একদল মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকায় তারা কেবল অন্ন নয়, বস্ত্র থেকে শুরু করে নিত্য-ব্যবহার্য জিনিস চোরাবাজার থেকে বেশি দামে ক্রয় করে, কিন্তু অধিকাংশ জনগণের হাতে সেই অর্থ না থাকায় বাজারে দ্রব্য থাকলেও তা ছুঁতে পর্যন্ত পারে না। না খেতে পেয়ে কেউ বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করে, কেউ সন্তান বিক্রয় করে, আবার কেউ ‘নবান্ন’ নাটকে কুঞ্জের মতো কুকুরের সঙ্গে খাদ্য সংগ্রহের অসম লড়াইয়ে নেমে পড়ে। আর কেউ পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে বা আত্মহননের পথ আশ্রয় করে। কেউবা আবার অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে নানা রোগে মারা যায়। এইভাবেই মন্বন্তরের হাত ধরে আসে মহামারি। তৎকালীন দুর্ভিক্ষ কমিশনের সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মন্বন্তর ও মহামারির প্রভাবে ১৯৪৩-এ প্রায় মৃত্যু হয়েছিল ১.৫ মিলিয়ন মানুষের। যদিও পরবর্তীকালে W.R. Aykroyd— ওই কমিশনের সদস্য স্বীকার করেছিলেন সংখ্যাটি ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন হবে। [৮]

তবে সেইসময়ে কলকাতার রাস্তা মৃতদেহের স্তূপে ভরে গেলেও তা ছিল মূলত গ্রামবাংলার মানুষের… যারা খেতে না পেয়ে দারিদ্র্যের জ্বালায় শহরে আশ্রয় চাইতো, কিন্তু চোরাকারবারি ও মহাজনদের হাতে পড়ে তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠত। প্রয়োজনীয় লঙ্গরখানাও থাকতো না, ফলে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে বা খেতে না পেয়ে ‘ফ্যান দাও মা, ফ্যান দাও’ বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। এই বাস্তবতা তৎকালীন যে কোনো সংবাদপত্রের পাতায় ছবিতে ও লেখায় ধরা আছে, ধরা আছে সাহিত্যিকের কলমে বা চিত্রকরের তুলিতে। আর সেইসব দলিলে চোখ রাখলেই আমরা দেখি কী আশ্চর্য মিল বর্তমানের সঙ্গে। প্রেক্ষাপট হয়তো ভিন্ন কিন্তু ছবিগুলো! না খেতে পেয়ে কাজ হারিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আসা শ্রমিকরা চাপা পড়ে রেলের তলায়, পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে আধপোড়া রুটি, কদিন আগেই এমন ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠেছিলাম না? আর তখনই মনে হয় ক্ষমতাবানের মুখোশ বদলায় মুখ বদলায় না, চরিত্র বদলায় না, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলায় না। পরাধীন দেশে মন্বন্তর ও মহামারির দৃশ্যে সাধারণ মানুষের অসহায়তার সঙ্গে মিলেমিশে যায় স্বাধীন দেশের মহামারির দৃশ্য।

 

ক্ষমতাবানের এই লোভের আরেকটা চেহারা দেখতে পাই চল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগের মধ্যে। এই দেশভাগের জন্য ব্রিটিশ সরকারের দ্বি-জাতিতত্ত্বের নীতিকে প্রধানত দায়ী করে আসা হয়। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, এই নীতি কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করেছে আমাদের দেশের নেতারাই। যাদের ক্ষুদ্র ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা এই দেশ বিভাজনের কাজকে তরান্বিত করে। যদিও এর বীজ অনেক পূর্বেই রোপিত ছিল, এখানে তার বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয় কিন্তু যদি চল্লিশের দশকের প্রেক্ষিতেই বিচার করি দেখব তৎকালীন সময়ে হিন্দু-মুসলিম দুই গোষ্ঠীরই বেশকিছু নেতা এই দেশভাগের পক্ষে ছিল। শরৎ বোসের মতো বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা যেমন এই দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন, তেমনি বিধান রায় বা নলিনীরঞ্জন রায়ের মতো বাংলা কংগ্রেসের নেতারা দেশভাগের পক্ষে ছিলেন। এছাড়াও ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিন্দু মহাসভা অন্যদিকে মুসলিম লিগ যাদের উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তন তৎকালীন জনজীবনকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলস্বরূপ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ও নোয়াখালিতে দাঙ্গা বাঁধে। তৎকালীন রিপোর্ট থেকে জানা যায় কলকাতা দাঙ্গায় ৪,০০০ লোক নিহত হয় এবং প্রায় এক লক্ষ লোক আহত হয়। আর নোয়াখালির দাঙ্গায় মারা যায় ৫,০০০ জন। আহতের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি। [৯] 

চল্লিশের দশকে এইভাবেই  প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সংকটেরপ্রেক্ষিতে এক সার্বিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলা অর্থাৎ বাংলার মানুষ, যাতে বদলে যায় বাঙালির যাপনের ধরণ, অখণ্ড বাঙালি সত্তার বিভাজন হয়, দৈনন্দিন নতুন জীবনে অনেক নতুন শব্দের আগমন ঘটে, উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল, শরণার্থী ক্যাম্প আরও কত কী! ঠিক যেমন বর্তমানে আমাদের এই সংকট শেখালো লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, নিউ-নর্মাল সোশ্যাল-ডিসটেন্স, আরও কতো! একথা তাই মনেই হয়, চল্লিশের পর যেমন বাঙালির এক নতুন সত্তা নির্মিত হয়েছিল হয়তো তেমনি এই সংকটের পরও আমাদের কোনো নতুন সত্তা নির্মিত হবে, যাপনের রূপ যে বদলাবে তা নিশ্চিত। সেই যাপন যেন মানবিক ও সুন্দর হয় সেই ভাবনাতেই চল্লিশের সংকটজাত কবিতাকে ফিরে দেখা।

 

চল্লিশের সেই সংকটের পটভূমিতে বহুকবিই কলম ধরেছিলেন, খ্যাত ও অখ্যাত মিলিয়ে সংখ্যাটি কম নয়। এমনই একটি কবিতা বিষ্ণু দের ‘এক পৌষের শীত’ কবিতাটি। যেখানে মন্বন্তরের বাস্তব ছবি যেমন কবি তুলে ধরেছেন তেমনি সেইসময় অতিক্রম করে সুস্থ জীবনে ফেরার পথের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

“দু চোখ ছায় বাংলাদেশের মাটি 

নদী ও খাল খামার তেপান্তর 

পৌষমাসে বাঁধি সোনার আঁটি

অনেক পরব দেশ যে উর্বর 

তবুও কোন মরিয়া পথ ভুলে 

এসেছি সব কোলকাতার পথে?

কোথা সমাজ? প্রাণ শিকেয় তুলে 

ছুটছে লোক আপন ধান্ধায় 

নানান্‌ রীতি নানা রকম রথে

ঘরের কাজে আপিস ঘরে কেউ। 

রূপার টানে সকাল-সন্ধ্যায় 

মজুতদারে চোরাবাজারে ঢেউ

লঙ্গরখানার শান বাঁধানো ভিড়ে

দেখিরে ভাই কোলকাতার কেতা,

রাজা উধাও টাঁকশালের ভিড়ে

কোথায় লীগ মহাসভার নেতা।” [১০]

 

চল্লিশের দশকে নগর কলকাতার বাস্তব নির্মম চিত্র এখানে তুলে ধরেছেন কবি, কিন্তু এই নির্মমতাই শেষ নয়, কবিতার শেষ হয় এক সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্নে—

“আমার মাটি সোনালি সমতলে    

ফিরেছি গাঁয়ে চষি আপন মাটি 

বিশ্ব ছেয়ে প্রাণের আগুন জ্বলে 

ফসল বেঁধে বাঁধি প্রাণের আঁটি” [১১]

 

তাঁর ‘চতুর্দশপদী’ কবিতায় ‘পোড়ামাটি নীতি’র সমালোচনা করে তিনি বলেন—

“খাস ইংরাজী কাগজের টাকা জাপানী ফানুসে লাল

বিস্তর লোক বেচে দেয় বটে কাস্তে হাতুড়ি হাল 

জাল দড়ি মাকু, বিস্তর লোক ভিখারী সেজেছে বেশ” [১২]

 

মন্বন্তরের হাত ধরেই এসেছিল মহামারি। বহুলোক মারা গিয়েছিল কলেরা, ম্যালেরিয়া বা অন্যান্য রোগে। সরকারি হিসেবে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আমাশয় ও অন্যান্য পেটের অসুখে ৪১০৬৭ জন, কলেরায় ৫৮২৩০ জন, ম্যালেরিয়ায় ১৬৮৫৯২ জন ও জ্বর-পীড়ায় ১,৫৯,৩৯৮ জন মারা যায়।  [১৩] যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বাধিক। বিষ্ণু দে ‘১৯৪৩’, ‘অকাল বর্ষায়’ কবিতায় এই দুর্ভিক্ষ ও মহামারির যৌথ আক্রমণে অসহায় মানুষের যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেন এই ভাষায়—

“সকাল না হতে কাঁপে ক্রন্দসী ও চালের আড়তে

অনাহারে অসহায় কাতারে কাতারে কোনমতে 

কুইনিনহীন দেহ ঢেকে কাঁপে ক্ষুধার্ত নির্বোধ” [১৪]

 

কিন্তু বিষ্ণু দের কবিতায় কেবল যন্ত্রণা ও নির্মমতার ইতিহাস নয় ধ্বনিত হয় প্রতিরোধের চড়া সুর ও ‘দুর্ভিক্ষের বঞ্চিত হাতে বানাবো বিজয়ী বেশ।’ [১৫]

 

দিনেশ দাসের ‘ডাস্টবিনে’ কবিতায় এইসময়ে মানুষের চূড়ান্ত অসহায়তার রূপ দেখি—

“মানুষ এবং কুত্তাতে

আজ সকালে অন্ন চাটি একসাথে

আজকে মহা দুর্দিনে 

আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে।” [১৬]

 

এই পংক্তিগুলির সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই ‘নবান্ন’ (বিজন ভট্টাচার্য) নাটকের সেই বিয়েবাড়ির দৃশ্যের সঙ্গে। যেখানে বিয়ে বাড়ির সামনে ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য কুঞ্জ ও রাধিকার সঙ্গে অসম লড়াইয়ে ব্যস্ত সারমেয়র দল দংশন করে কুঞ্জকে। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না সময়ের বাস্তবতাকে, কিন্তু কবি কেবল অসহায়তার ছবি অঙ্কন করেননি, এই অসহায়তার জন্য দায়ী যেসব মহাপুরুষ তাদের শেষের সে দিনের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন—

“আজ যে পথে আবর্জনার স্বৈরিতা

মহাপ্রভু! সবই তোমার তৈরি তা

দেখছি বসে দূরবীনে

তোমায় শেষে আসতে হবে তোমার গড়া ডাস্টবিনে।” [১৭]

এই বার্তা কেবল তৎকালীন মহাপ্রভুদের জন্য নয়, বর্তমানের মহাপ্রভুদেরও এই বার্তা দেওয়ার সময় এসে গেছে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথায় আমাদের ও শপথ নেওয়ার দিন—

“আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই/ স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের/ চিতা আমি তুলবই। (বোধন) [১৮] আসুন না কবির এই বার্তা পৌঁছে দিই আজকের স্বৈরাচারী শাসকের কাছে, যারা আজও কোটি-কোটি জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাহস পায়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চল্লিশের পটভূমিতে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এখানেও সেকথা স্মরণ করা যায়— 

“তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা;/ অনেক দুঃখে মথিত শেষ বিদ্যে শেখা।/ অগণ্য চাষী-মজুর জেগেছে শহর গ্রামে/ সবাই দিচ্ছি চরমপত্র একটি খামে/ পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই।/ বহু উপহার দিয়েছ-শাস্তি, ফাঁসি, গুলি,/ অরাজক, মারী, মন্বন্তরেমাথাখুলি।/… এতদিন বহু আঘাত হেনেছ, পেয়ে গেছ পার,/ ভুলিনি আমরা, শুরু হোক শেষ হিসাবটুকু তার।” [১৯] বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হয় আর বোধহয় এই বেশ ভালো আছি ভেবে সময় নষ্ট করার সময় নেই, হিসেব বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে।

 

চল্লিশের আরেক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাতেও মন্বন্তর ও তার প্রতিরোধের চিত্র আছে। যেমন ‘চিরকূট’, যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিত্র অঙ্কিত হয়—

“মাঠে ঘাটে কপাল ফাটে

দৃষ্টি চলে যতদূর

খাল শুকনো বিল শুকনো

চোখের কোলে সমুদ্দুর।” [২০]

 

তবে কেবল অসহায়তার কথাই নয় জেহাদও আছে এই কবিতায়—

“পেট জ্বলছে খেত জ্বলছে

হুজুর জেনে রাখুন

খাজনা এবার মাপ না হলে

জ্বলে উঠবে আগুন।” [২১]

 

শুধু তাই নয় তিনি এই সংকট মুক্তির পথ হিসেবে মানুষের স্বপ্ন‌ ও প্রয়াসের উপরে আস্থা রেখেছেন—

“তবু তারা স্বপ্ন দেখে

স্বপ্ন তাকে করাঘাত করে

ডাক ওঠে শহরে শহরে

রাস্তার শ্মশান থেকে

মৃতপ্রায় জনস্রোত থেকে

মাঠের ফসল দিন গোনে

প্রতিজ্ঞা কঠিন হাতে

 একে একে তারা সব

 চোখের শোকাশ্রু মুছে ভাবে

 ঘরে ঘরে নবান্ন পাঠাবে” [২২]

 

মন্বন্তর ও মহামারির এই বিপর্যয় কাটতে না কাটতেই বাংলার ভাগ্যাকাশে দাঙ্গা ও দেশভাগের বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে যা বাঙালির এতদিনের চিন্তা-চেতনায় এক বড় আঘাত হানে। কারণ মনে রাখতে হবে এই দেশভাগ বা দাঙ্গা কোনটিই সাধারণ মানুষের চাহিদা ছিলো না, মনে পড়বে অন্নদাশঙ্করের সেই বিখ্যাত ছড়া—

“তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পড়ে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা।” [২৩] এই বুড়ো খোকাদের চিহ্নিত করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণাত্মক ভাষায় লেখেন—

“খবরের কাগজ নাকি বাংলা ভাগ করতে চায়?

নেতারা নাকি ভাতের হাঁড়ি ভাগ করতে ইচ্ছুক, বড়লাটের আজ্ঞায়?

হাঁড়ি ফাটলে যে ভাত পুড়ে ছাই হবে উনানের আগুনে,

শ্রমার্ত ক্ষুধার্থ আমরা খাব কী?

কী খাবে আমাদের হাড় গিলে বৌগুলি, ন্যাংটো নচ্ছার ছেলেমেয়ে?

পঁয়ত্রিশ লক্ষ মরলাম

মরলাম শুধু ওই নেতাদের লাটেদের খেয়ালে

আরও দুচার কোটি মরব 

দামি পেনের, এপ্রিল হৃদয়ের মমতায় শোকভরা লেখনীর, 

নেহেরুর নখের আঁচড়ে জিন্নার গরিব মুসলমানের প্রতি দরদে,

দাঙ্গা, কারফিউ ব্যর্থ ও মিথ্যায়?

নেতাদের নেতারা বাংলা ভাগ করতে চায়…” [২৪]

 

এই কবিতায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুমাত্র মানুষের অসহায়তার জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিতই করেননি, প্রতিরোধের কথাও বলেছেন—

“কিন্তু ভাইরে,

আর মরা যায় না। 

যত পারি মরেছি, আর মরা যায় না

মাইরি বলছি কালীর দিব্যি খোদার দোহাই,

আর মরা যায় না কিছুতেই।

তাই ঈশ্বর আল্লা নেতা লাটদের বাদ দিয়ে এবার বাঁচতে চাই,

মানুষ নিয়ে মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।” [২৫]

 

মানিকের মতো এত স্পষ্ট করে না হলেও অচিন্ত্য সেনগুপ্ত তাঁর ‘পূবপশ্চিম’ কবিতায় শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন—

“আমাদের শত্রু ও সেই এক

যারা আমাদের আস্ত মস্ত সোনার দেশকে 

খণ্ড খণ্ড করছে

যারা আমাদের রাখতে চায় বিচ্ছিন্ন করে বিরূপ করে

বিমুখ করে।” [২৬]

 

এই বিচ্ছিন্নতা এই বিরূপতাই ভয়ঙ্কর হয়ে প্রকাশ পায় দাঙ্গারূপে। বলা যায় দাঙ্গায় কেবল মানুষের নয় মৃত্যু হয় মানবাত্মার। অর্থনৈতিক দৈন্যতা অপেক্ষা বিশ্বাসের দৈন্যতা অনেক ভয়ঙ্কর। ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায় তৎকালীন সময়ের চিত্রায়নে কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের সেই দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন—

“ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হত/ ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ছেলে মাঝি বাগদির/ ঈশ্বরী মেয়ের সাথে/ বিবাহের কিছু আগে-বিবাহের কিছু পরে-সন্তানের জন্মাবার আগে।/ সে সব সন্তান আজ এ যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়/ ক্লান্ত লোক সমাজের ভিড়ে চাপা পড়ে/ মৃতপ্রায়; আজকের এইসব গ্রাম্য সন্ততির/ প্রপিতামহের দল হেসেখেলে ভালবেসে অন্ধকারে-জমিদারদের/ চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।/ ওরা খুব বেশি ভালো ছিল না; তবুও/ আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায়/ অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে/ পৃথক আরেক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিলো।” [২৭]

 

সত্যিই গ্রামবাংলার মানুষ কোনোদিনই হয়তো খুব অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল না। জমিদার ইজারাদার পত্তনিদারদের অত্যাচারের মর্মান্তিক বিবরণ পাই উনিশ শতকের মনিষী অক্ষয়কুমার দত্তের ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন’ শীর্ষক রচনায়। কিন্তু কবি জীবনানন্দ তা সত্ত্বেও বলেছেন এই দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলায় যে বিশ্বাসহীনতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার থেকে পৃথক এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিলো পূর্ব প্রজন্ম। এই দাঙ্গা কীভাবে ভাতৃহত্যায় মেতে উঠেছিল, ধর্মান্ধতায় মেতে উঠেছিল তার নিদারুণ বর্ণনা আছে এই পংক্তিগুলিতে— 

“ঘুমাতেছে।

যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে

বলে যাবে কাছে এসে ইয়াসমিন আমি,

হানিফ মহম্মদ, মকবুল করিম আজিজ

আর তুমি? আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে

চোখ তুলে শুধাবে সে,— রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে

বলে যাবে ‘গগন, বিপিন শশীপাথুরে ঘাটার

মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গালিফ স্ট্রীটের, এন্টালির

কোথাকার কেবা জানে?’ ” (২৮)

 

হতাশ কবি তাই বলেন ‘এই যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো ক্লান্তিময় আলো/ চোখের সম্মুখে নেই যাত্রিকের’ [২৯] কবির এই হতাশা যেন গ্রাস করেছে আমাদেরও বর্তমান সংকটকে। কারণ খুব গভীর পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় আজকের সংকটও একমুখী নয় বরং ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে সমাজে যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, নতুন করে ধর্মান্ধতাকেও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, নতুন করে যখন যুদ্ধের দামামা বেজেছে, তখনই জীবনানন্দের কবিতার পঙক্তি গুলি মনে পড়ে—

“মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর,

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীবোল;

মানুষের লালসার শেষ নেই;

উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ

অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ

অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ

নেই,

কেবলই আসন থেকে বড়ো নবতর

সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো।

মানুষের দুঃখ-কষ্ট মিথ্যা নিষ্ফলতা বেড়ে যায়…’’ [৩০] 

 

আরেকবার সত্যি প্রমাণ হয়, কবিরাই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তবে আমাদের কী করণীয়? এমন জিজ্ঞাসার উত্তর পাই কবিরই কাছে— ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’…. [৩১] আর এই প্রত্যয় থেকেই তো জীবনানন্দের অনুজ কবি শঙ্খ ঘোষের মতো আমরাও এই সংকটে দাঁড়িয়ে একটাই প্রার্থনা করি— ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’ [৩২]

চল্লিশের একটা বড় সংকট দেশভাগ। যে ধর্মান্ধতা দাঙ্গাকে সংঘটিত করেছিল সেই ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে নেতারা আপন আপন ক্ষমতালাভের কৌশলে ৪৭-এ করলো দেশকে দু’টুকরো। ভাগ হলো বাঙালির অখণ্ড জাতিসত্তার চিন্তন। ৭১-এ এসে যা সম্পূর্ণতা পেলো। আর এই দেশভাগ কেবল তাৎক্ষণিক ক্ষয় করল না, তার ক্ষয়ের ধারা আজও বহমান। আজও পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে যারা এই দেশভাগের কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই আত্মপরিচয়ের সংকট বহমান। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে NRC বা CAA-র মতো বিষয়গুলি যেন আরেকবার সেই আত্মপরিচয়ের সংকটকে তীব্র করেছে। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘জাবাল সত্যকাম’ কবিতার পঙক্তিগুলি—

“কোথায় আমার দেশ কোন স্থিতি মৃত্তিকার কুল

কোন চোখে চোখ রেখে বুকের আকাশ তরে মেঘে

দেশ দেশান্ত কাল কালান্তর কোথায় আমার ঘর

তুমি চাও গোত্র পরিচয়।” [৩৩]

 

ভিটেমাটি ছেড়ে এসে আত্মপরিচয়হীন হয়ে পড়া এই মানুষগুলির কাছে এ যেন এক নির্বাসন। সুনীল গাঙ্গুলির কবিতায় সেই বেদনার অনুভূতি প্রকাশ পায়।

“যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো আমি বিষপান করে মরে যাবো। 

বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ

নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ

প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ

এই আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম

যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো

আমি বিষপান করে মরে যাবো।” [৩৪]

 

তবে এই হাহাকারই শেষ নয়, বুড়ো খোকাদের রাজনীতির ধ্যাষ্টামোকে অস্বীকার করে সাধারণ মানুষই অখণ্ড বাঙালির সত্তাকে নির্মাণ করতে পারে এই আত্মবিশ্বাসের সুরই ধ্বনিত হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পারাপার’ কবিতায়—

“আমরা যেন বাংলাদেশের

চোখের দুটি তারা

মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে

থাকুক গে পাহারা

দুয়ারে খিল

টান দিয়ে তাই

খুলে দিলাম জানলা

ওপারে যে বাংলাদেশ

এপারেও সেই বাংলা।” [৩৫]

 

সুনীল গাঙ্গুলির ‘সাঁকোটা দুলছে’ কবিতাতেও ধর্মের ঊর্ধ্বে বাঙালির অখণ্ড সত্তার বিশ্বাসই ধ্বনিত হয়—

“এপারে ওপারে ঢিল ছুঁড়ে ডাকাডাকি

ওদিকের গ্রামে রোদ্দুর কিছু বেশি

ছায়া ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় কটি পাখি

ভরা নৌকায় গান গায় ভিন দেশি

সাঁকোটার কথা মনে আছে আনোয়ার?

এত কিছু গেল সাঁকোটা এখনো আছে

এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার

সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে।” [৩৬]

 

কবিদের বিশ্বাসের এই পথেই  বাঙালির তথা মানুষের অখণ্ড সত্তা নির্মাণ সম্ভব। যে সত্তা ধর্মের বা দেশকালের বেড়াজালে বদ্ধ নয়, যে সত্তা ক্ষমতাবানের চোখে চোখ রেখে প্রতিরোধ করতে জানে, প্রতিবাদ করতে জানে। এই সার্বিক সংকটে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রাজরোষ, ক্ষমতার রাজরোষ থেকে বাঙালি তথা মানব জাতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদের একটাই মন্ত্রে বিশ্বাস করতে হবে ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’… [৩৭] এই বাঁধন হবে আত্মিক। পারস্পরিক দোষারোপ নয়, কোনো হতাশা নয় বরং পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখকে সারিয়ে তুলতে হলে আমাদের দায় নিতে হবে, আমাদের মনে রাখতে হবে—

“আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে

আমরা দুজনে সমান অংশীদার

অপরে‌ পাওনা আদায় করেছে আগে 

আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার।” [৩৮]

 

সত্যিই এই দেনা আমাদের শোধ করতেই হবে। আগামী দিন নইলে বড় ভয়ঙ্কর হয়ে আসবে— কোনো একটা করোনা বা আম্ফান নয়, বিপর্যয়ের জাল মানব জীবনের অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে, যা মানুষকে দুটি বিশ্বযুদ্ধের কাল পেরিয়েও আরেক বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মানুষ তো হারতে জানে না, তাই চল্লিশের সংকট পেরিয়েও বাঙালি তার সত্তাকে নতুনভাবে নির্মাণের যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সেই পথেই বিশেষ করে কবিদের প্রত্যয়ী উচ্চারণেই আমরা আজকের সংকটকেও কাটিয়ে উঠব। বুকের গভীরে এই প্রত্যয় রেখেই চল্লিশের এক কবির ভাষাতেই অঙ্গীকার করি—

“তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।” [৩৯]

 

 

তথ্যসূত্র:

১) দত্ত সুধীন্দ্রনাথ, ‘সংবর্ত’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সম্পাদনা জগন্নাথ চক্রবর্তী, প্রকাশক-দেজ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রকাশকাল ২০০২, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২১।

২) দাশ জীবানন্দ, ‘সুচেতনা’, জীবনানন্দ দাশের কাব্য সমগ্র, সম্পাদনা ক্ষেত্র গুপ্ত, প্রকাশক ভারবি, কলকাতা ৭৩, প্রকাশকাল ২০০৪, পৃষ্ঠা ১০৯।

৩) Sen Amartya. ‘Great Bengal famine’ (chapter 6). Poverty and famines. An essay on entitlement and the Deprivation. Oxford University press New york. 1981. PP 63.

৪) চৌধুরী বিনতা, ‘মন্বন্তর ও সাহিত্য’ (প্রথম অধ্যায়), পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলা সাহিত্য, প্রকাশক সাহিত্যলোক কলকাতা-৭০০০০৬, প্রকাশকাল ১৯৯৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১।

৫) তদেব, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১১।

৬) তদেব।

৭) তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩।

৮) তদেব, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯।

৯) চ্যাটার্জি জয়া, ‘দ্বিতীয়বারের বাংলা বিভাগ ১৯৪৫-১৯৪৭’ (ষষ্ঠ অধ্যায়), বাংলা ভাগ হলো হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ ১৯৩২-১৯৪৭, অনুবাদক আবুজফর, প্রকাশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা-১০০০, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫৯-৩১১।

১০) দে বিষ্ণু, ‘এক পৌষের শীত’, বিষ্ণু দে-র শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রকাশক দেজপাবলিশিং কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রকাশকাল ১৯৯২, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭০-৭১।

১১) তদেব, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭১

১২) দে বিষ্ণু, ‘চতুর্দশপদী’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭।

১৩) চৌধুরী বিনতা, মন্বন্তর ও সাহিত্য (প্রথম অধ্যায়), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯।

১৪) দে বিষ্ণু, ‘১৯৪৩-অকালবর্ষা’, অরণি, সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, ২৩ জুলাই, ১৯৪৬, কলকাতা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৮৯।

১৫) দে বিষ্ণু, ‘চতুর্দশপদী’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭।

১৬) দাস দীনেশ, ডাস্টবিন, ই. 

[http://www.milansagar.com/kobi/dinesh_das/kobi-dineshdas.html] Date: 13th March 2022.

১৭) তদেব।

১৮) ভট্টাচার্য সুকান্ত, বোধন, ই.  

[https://sahittosomvar.wordpress.com/2013/03/23/%E0%A6%AC%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%AD%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF/], Date: 13th March 2022.

১৯) ভট্টাচার্য সুকান্ত, চরমপত্র, ই.  

[https://banglashikha.com/chorompotro/], Date: 13th March 2022.

২০) মুখোপাধ্যায় সুভাষ, ‘চিরকুট’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রকাশক-দেজ পাবলিশিং, কলকাতা ৭৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫।

২১) তদেব।

২২) মুখোপাধ্যায় সুভাষ, ‘স্বাগত’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৬।

২৩) রায় অন্নদাশঙ্কর, খুকু ও খোকা, ই.

[http://www.milansagar.com/kobi/annadashankar_roy/kobi-annadashankarroy.html], Date: 13th March 2022.

২৪) বন্দোপাধ্যায় মানিক, ‘বাংলা ভাঙার কবিতা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, সম্পাদক যুগান্তর চক্রবর্তী, প্রকাশক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি, কলকাতা-২০, প্রকাশকাল ২০০২, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪০।

২৫) তদেব।  

২৬) সেনগুপ্ত অচিন্ত্য, পূব-পশ্চিম, ই.

[https://sabujsathi.wordpress.com/category/%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%AC-%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%AE/], Date: 13th March 2022.

২৭) দাশ জীবনানন্দ, ‘১৯৪৬-৪৭’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩২৭।

২৮) তদেব, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩২৮

২৯) তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৩২৯

৩০) দাশ জীবনানন্দ, ‘এই সব দিনরাত্রি’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাসংখ্যা-৩২৩। 

৩১) দাশ জীবনানন্দ, ‘মানুষের মৃত্যু হলে’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৩৩১।

৩২) ঘোষ শঙ্খ, ‘বাবরের প্রার্থনা’, শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রকাশক দেজ পাবলিশিং, কলকাতা ৭৩, প্রকাশ কাল ২০১১, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৫।

৩৩) ঘোষ শঙ্খ, ‘জাবাল সত্যকাম’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৯

৩৪) গঙ্গোপাধ্যায় সুনীল, যদি নির্বাসনদাও, ই.  

[https://sahittosomvar.wordpress.com/2013/03/25/%E0%A6%AF%E0%A6%A6%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B2-%E0%A6%97/], Date: 13th March 2022.

৩৫) মুখোপাধ্যায় সুভাষ, ‘পারাপার’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রকাশক দেজ পাবলিশিং, কলকাতা ৭৩, প্রকাশকাল ২০০২, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫০।

৩৬) গঙ্গোপাধ্যায় সুনীল, সাঁকোটা দুলছে, ই.  

[https://stethoandpen.in/2020/07/19/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B2-%E0%A6%97%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97/], Date: 13th March 2022.

৩৭) ঘোষ শঙ্খ, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’, শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯১।

৩৮) দত্ত সুধীন্দ্রনাথ, ‘উটপাখী’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০১।

৩৯) ভট্টাচার্য সুকান্ত, ছাড়পত্র, ই.

[https://priyokobita.wordpress.com/2011/02/06/charpotro/], Date: 13th March 2022.

লেখক পরিচিতি:

প্রফেসর সুনিমা ঘোষ, বাংলা বিভাগ, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, মালদা, পশ্চিমবঙ্গ। 

ই-মেইল— sunimaghosh70@gmail.com 

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *