পাঠ প্রতিক্রিয়া: ক্রান্তিবৃত্তের পালা রবীন্দ্র গুহ

কুসুম, রাজবীরের চেয়ে বড় ক্রান্তিনারী

তৃ প্তি  সা ন্ত্রা

রসেবশে বাঙালি পাঠকের কাছে রবীন্দ্র গুহ খুব জনপ্রিয় নন। পরিচিত নন। মান্য বাংলায় লেখা, মান্য বাঙালির জীবনযাপন, প্রেম-ভালোবাসা, দুঃখ-লড়াই সব আমরা আমাদের নাগালের ভাষা, উপমা, কল্পনার বুননে দেখতে, পড়তে ভালোবাসি। ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’, ‘জাতের নামে বজ্জাতি’, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’— এইসব এতোটাই শিরোনামে, যে আমরা চিরদিন শ্রেণিবৈষম্য নিয়ে লড়ে এলাম। বর্ণবৈষম্যের অস্তিত্ব স্বীকারেও অনীহা আমাদের।

 

এই রাজ্যে নিম্নবর্গ নেই। দলিত নেই। অপর নেই। থাকলেও আমাদের কল্পনার বুননে, আমাদের নির্মাণে, আমাদের মতো করে আছে।

 

রবীন্দ্র গুহ প্রবাসী। বাংলার বাইরে থেকেছেন। ক্রান্তিবৃত্তের পালা-র ব্যাক-কভারে সঞ্জীব নিয়োগীর ভাষ্য অনুযায়ী—

 

“রবীন্দ্র গুহ-র পাকস্থলিতে বাংলার নিম-পাচন, মগজে রাজস্থানী খুঁখার প্রেম, হৃদয়ে জাঠ দৃঢ়তা, অ্যাটিটুডে রাজধানীর অধুনান্তিকতা, অতিক্রান্ত জমিনের বৃত্ত, ডায়াসপোরিক লেভেল ক্রসিং।’’ [১]

 

সহজ কথায় অর্থ হয় বিষয়বস্তুতে, উপস্থাপনা রীতিতে কিংবা ভাষাপ্রয়োগ আর চেতনাবিশ্বের নির্মাণে অজানা জগতের কথকতা করে যান রবীন্দ্র গুহ।

 

শুখায়রার দেশ হরিয়ানায় অবস্থানের জন্য, ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের সান্নিধ্যে থাকার ফলে আমরা পেলাম ভারতীয় ভূগোল-ইতিহাস-লোকবৃত্তকে নির্মাণের দুঃসাহসিক প্রয়াস। পেলাম অপাংক্তেয় নিম্নবর্গীয় প্রায়-অনাবিষ্কৃত ভারতকে।

 

রবীন্দ্র যখন চুড়াচামার লিখলেন, সে-ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদেরই— আরাবল্লির ড্যালাডুমরি পথের মতোই ইশারা। ফৌজ-ই রাজবীর এক আজব দেশের কথা শোনায় জাতভাই চুড়াচামারদের। পাহাড়ের ওপারের একদেশ, সেখানকার মানুষগুলো ‘বেজায় খুঁখারা আর এ্যাঁড়াবেঁড়া’, [২] ‘আর তাড়া ফল-ফলাদি মাস-মছলি যত ভালো ভালো খাবার দরিয়ায় ফেলে দেয়।’ [৩] আর ‘যত পচা, শড়াগলা জিনিস খায়।’ [৪] এই যে এক জনগোষ্ঠী যাদের এইরকম খাদ্যাভ্যাস জেনে আমাদের নাক কোঁচকায়, ঠোঁট বেঁকে যায়, রাজবীরের সঙ্গে সবাই যেতে চায় সেই ‘সব পেয়েছির দেশে’… ‘বলো কি? তা দম বন্ধ হয়ে যাবার মতই কথা। এমন একটা মজার দেশ, চলো আমরা সবাই ওখানে চলে যাই। ভালো-ভালো খাবো, ভালো থাকবো।’ [৫]

 

কিন্তু তাদের যাত্রা পর্ব অত সহজ  নয়। ‘গাঁয়ের মালিক তাউজি, সে মানবে কি? আমরা গেলে, গাঁয়ের সাফ-সাফাই করবে কারা? খামারে কাজ করবে কারা?’ [৬] হ্যাঁ। এরা চুয়াড়-চামার। সাফাইকর্মী। রাজবীর যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার সাথে কোমর বাঁধে দীর্ঘ শালবৃ্ল্লার মতো চেহারা, লম্বা ঝাঁপসানো চুলের খরাজ। সব-সময় তার কাঁধে একটা শাবল থাকে আর কোমরের চাকু। শাবল দিয়ে লোকের বাড়ি সিঁদ কাটে। আর ছুরি দিয়ে শুয়োরের চাম ছোলে। আর তাদের সঙ্গে জোট বাঁধে আহিরদের যুবতী কুসুম। তাউজি আর তার দলবল যথাসাধ্য বাধা দেয়— গাঁয়ের লোকদের যেন এই চক্করে না টানে রাজবীর। কিন্তু রাজবীর ক্রান্তিকার। উৎসাহদাত্রী কুসুম ‘ভালো কাজ করতে হিম্মত রাখতে হয়’ [৭] বলে তাঁতায় তাকে। আর এই হিম্মত দেখাতে গিয়ে রাজবীর, কুসুম ধরা পড়ে তাউজির পহেল্‌বানদের হাতে।

 

কুসুমের প্রথম বর রাখুরাম চামার। দ্বিতীয় বর রামলখনের ছেলে ওমবীর মুচি। তৃতীয় বর কসাই নাথুরাম। এই মেয়ে মারাত্মক জাদু জানে। ওর চুলের বিনুনিতে আগুন জ্বলে। বংশানুক্রমিক বৃত্তি ছেড়ে শরীরটা ঝেড়েপুছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল কুসুম তার তিন মরদকে— তারা কেউ-ই সাহস দেখাতে পারেনি— মরদদের ছেড়ে এসেছিল কুসুম। এখন তাঁতাচ্ছে রাজবীরকে। তাউজির লোকেরা তাকে নাঙা করে স্তনুয়া কেটে দিতে চায়। ক্রান্তিকার রাজবীরকে তারা পিটায়, বেঁধে রাখে। আর ছেড়ে দিতে চায় যদি রাজবীর বেউশ্যা মেয়েটাকে তাদের হাতে তুলে দেয়। এ-কথায় রাজবীর ফুঁসলে উঠলে, ধ্যান সিং জগ্গু তার পিঠের চাম তুলে দেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে— তখন কুসুম আর বসে থাকতে পারল না— ভয়ংকররূপিনী তার মূর্তি। অবিকল ছিন্নমস্তার মতো…

 

অভ্যন্তরে স্বল্প পরিসরের আখ্যানে কুসুমকে নিয়ে বিস্তারিত বলেননি রবীন্দ্র গুহ, কিন্তু চরিত্রটি জাদু ও বাস্তবতা দিয়ে আমায় মুগ্ধ করে রাখে। সামাজিক দমনকে অস্বীকার করে নিজের জাতধর্ম ত্যাগ করে অন্য পৃথিবীর স্বপ্নে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিল কুসুম তার মরদদের— ভাবনাতে ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে আগুন জ্বালাবার সাহস কুসুম। কুসুম তাই রাজবীরের চেয়ে বড় ক্রান্তিকারী।

 

শুরুতেই বলেছি ক্রান্তিবৃত্তের পালা আখ্যান (উপন্যাস?) অন্য ভূগোল, অন্য পৃথিবীর গল্প বলে। বর্ণ বিভাজিত এই ভূগোলে উচ্চবর্ণের দাপট। আর্য, পাণ্ডবগুরু দ্রোণাচার্য, মহাদেব, যদুবংশের কিষাণজির লীলাক্ষেত্র এই আরাবল্লি— পুরাণের দোহাই দিয়ে তাউজিদের আর বানিয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য চুয়াড় চামারদের ওপর।

 

ক্রান্তিকারী ছিল রাজবীর, কুসুম, খরাজ। ‘দীর্ঘ শালবৃল্লার মতো চেহারা, লম্বা ঝাঁপসানো চুল’ [৮] সেই খরাজ কোথায়? বইয়ের ২৩ পাতায় পাচ্ছি—

 

“জাট-গুজার-যাদবরা এক জোট হয়ে আরাবল্লী পাহাড়ের চপ্পা-চপ্পা খুঁজল কুসুম, রাজবীর, জগ্গুকে।” [৯]

 

কে এই জগ্গু? ক্রান্তিবৃত্তের পালা-এক এই অধ্যায়ে তাকে তো আমরা তাওজির লোক হিসেবেই পেয়েছি, যে নাঙা করেছিল কুসুমকে। কেটে নিতে চেয়েছিল তার স্তন।

 

ক্রান্তিবৃত্তের পালা-দুই অধ্যায়ে দেখি জগ্গু ক্ষুধা মেটানোর জন্য কিছু একটা করতে চায়। আমরা দেখি চকরপুরের সুন্দরলাল যাদবের বাড়ি সিঁদ কাটার কিসস্যা। সুন্দরলালের বুড়িয়া বিবি আর রাখোলিন্‌। কুন্দনলালের টাকা গোনা। কিন্তু জগ্গু দেখেছে জাদু চাঁদ-ঘন লাল। আরাবল্লী অজানা ভূগোল-জনজাতি-ভাষার বন্দরে ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারি না কখন থেকে রাজবীরের সাথী হলো খঞ্জর জগ্গু। খরাজ গেল কোথায়?

 

ক্ষমতার বিরুদ্ধে জেহাদে, অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য আসে নানা মায়া— জাদুবাস্তবতা নিয়ে নানা ঘোর। পাখি ধরার শবর মন্ত্র। পাহাড় ডিঙিয়ে অন্য রাজ্যে যাবার স্বপ্ন দেখিয়েছে রাজবীর— সেই স্বপ্নে মাতাল চুয়াড় চামাররা। ধন-সম্পদ ভোগবিলাস নয়, সেখানে আছে পেট ভরে খাওয়ার স্বপ্ন। এখনও অনার্যভারত। দলিতভারত। আটকে আছে ওই ক্ষুধার আগুনে। আটকে আছে উলকি আঁকা জাতি পরিচয়ে। সেখানে থেকে বেরোতে পারেনি। তবে তাউজির রাজপাট থেকে মুক্তি চেয়ে, পাথর কেটে অন্য পৃথিবীতে যাবার স্বপ্ন বোনা আছে এই আখ্যান।

 

অচ্ছুৎদের আছে নানা জাদুবাস্তবতা। আছে ছিন্নমস্তা— বোন ধোয়ানি— লোটাতোলার কিসস্যা। খরার জল পুরোহিতের বিধানে আঁধার রাতে মেয়েরা কালো চুলে খোঁপা বেঁধে তার ওপর জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে গীত গাইতে গাইতে পাহাড়ে যাবে। প্রদীপ লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়া হবে। প্রদীপ নিভে গেলে আকাশে ললছোঁয়া চাঁদ দেখা যাবে। তা শুভ। বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। প্রদীপ-সহ গর্ভবতী ফুলমণি লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। কিন্তু লড়াই থামেনি।

 

ক্ষুধা। উল্কি আঁকা হাতে পরিচয় মুছে ফেলার কিসস্যা ক্রান্তিবৃত্তের পালা। বাংলা সাহিত্যে, মুখ্য আরও বাঙালি জীবন। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতীয় পরিসর কই! এই উপন্যাস জাঠ-গুর্জার এবং চুড়াচামারদের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং হিংসার দলিল। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান নয়, প্রাণটুকু টিকিয়ে রাখাই মহা দায় এ অন্য ভুবনে।

 

“পাহাড়ী বিরান বনভূমি থেকে, প্রাচীন বৃক্ষরাজি থেকে ‘ও প্রাণ! প্রাণ রে’ কথাগুলি উদ্‌গত হয়ে অতিক্ষীণ অথচ ভয়ঙ্করভাবে হাওয়ায় ভাসতে থাকল।” [১০]

 

শুধু ভাসতেই থাকে না আজকের ভারতবর্ষে অন্ত্যজের প্রতি প্রতিদিনের হিমশীতল ঔদাসীন্য এবং সংগঠিত হিংসা এই ‘প্রাণের’ বিপন্নতা টের পাইয়ে দেয়।

 

 

 

তথ্যসূত্র:

 

১। রবীন্দ্র গুহ, ক্রান্তিবৃত্তের পালা, কলকাতা: দমদম জংশন পাবলিকেশন, ২০১৮, পৃ. ব্যাক-কভার।

২। তদেব, পৃ. ৬।

৩। তদেব।

৪। তদেব।

৫। তদেব, পৃ. ৭।

৬। তদেব।

৭। তদেব, পৃ. ১৭।

৮। তদেব, পৃ. ৭।

৯। তদেব, পৃ. ২৩।

১০। তদেব, পৃ. ৬২।

লেখক পরিচিতি:

তৃপ্তি সান্ত্রা

সাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ

ই-মেইল: santratripti56@gmail.com

Array

আরও পড়ুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *